হাতি শিকার করতে পারে এমন সাতটি প্রানী
অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, হাতি শিকার করতে পারে এমন কোন প্রানী কি আছে? এমন প্রশ্ন মনে আসার কারন হচ্ছে হাতির বিশাল আকার ও ওজন। স্থলভাগের সবছেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রানী হাতি। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতির গড় ওজন হয় ৫৫০০ থেকে ৬৮০০ কেজি এবং উচ্চতা সাড়ে দশ ফুটের মতো হয়। স্থলভাগে, হাতির ছেয়ে বড় আর ওজনের আর কোন প্রানী নেই। তাই অনেকেই জানতে চায় এত বড় ও শক্তিশালী প্রানীকে অন্য কোন প্রানী কি শিকার করতে পারে কিংবা কিভাবে হাতিকে অন্য প্রানীরা শিকার করে?
আজকের এই পোস্টে আমরা জানবো হাতি শিকারী এমন কিছু প্রানী সম্পর্কে যারা আকারে ছোট হয়েও হাতির মতো বিশাল আকারের শক্তিশালী প্রানীকে শিকার করতে পারে।
হাতি শিকারী প্রানীঃ
০১. সিংহ
০২. আফ্রিকান বন্য কুকুর
০৩. হায়েনা
০৪. কুমির
০৫. মানুষ
০৬. রয়েল বেঙ্গল টাইগার
০৭. বিষাক্ত সাপ
০১. সিংহ
সিংহ হাতি শিকার করছে |
শিকার করার এই পদ্ধতিটা অনেক কঠিন ও কষ্টকর সিংহের জন্য। সিংহ ভালো করেই জানে হাতি অনেক শক্তিশালী শিকার। তাই সিংহ সব সময় হাতি শিকার করা এড়িয়ে চলে। তবে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে সিংহ হাতিকে আক্রমন করতে ছাড়ে না। কথায় আছে প্রয়োজন কোন নিয়ম মানে না। তাই প্রয়োজনের
তাগিদে জীবনের হারানো ভয় সাথে নিয়ে সিংহ হাতি শিকার করে। একটি সফল শিকারের পরে
দলের সবাই মিলে সেই হাতির মাংস খায়।
০২. আফ্রিকান বন্য কুকুর
হাতি শিকারীর তালিকায় দ্বিতীয় নামটি আসবে আফ্রিকান বন্য কুকুরের। এই কুকুরগুলো
অনেক সাহসী, শক্তিশালী এবং সামাজিক প্রানী। এরা দলবদ্ধভাবে শিকারের উপর হামলা করে টেনেহিচড়ে
শিকারকে হত্যা করে।
দলবদ্ধ আফ্রিকান বন্যকুকুর এতোটাই ভয়ংকর যে, জঙ্গলের সব প্রানীই এদের
ভয় পায়। শিকারের উদ্দেশ্যে এরা যে কোন প্রানীর উপরই আক্রমন করতে পারে। এমনকি শক্তিশালী
হাতিও এদের শিকার হতে পারে।
একদল আফ্রিকান কুকুর শিকার করার উদ্দেশ্যে হাতিকে আক্রমন করছে |
যদিও বেশিরভাগ সময় এরা ছোট আকারের প্রানী যেমন ওয়ার্থঅগ, বানর, ইম্পালা,
খরগোশ, শিয়াল, এন্টিলোপদের শিকার করে। বড় আকারের প্রানী যেমন, মহিষ, উইল্ডবিস্ট, হাতি এইসব
প্রানীদের সরাসরি আক্রমন না করে এদের বাচ্চাদের টার্গেট করে আক্রমন করে।
বন্য কুকুরগুলো হাতির তুলনায় আকারে অনেক ছোট হলেও এরা প্রচন্ড সাহসী।
আর এই সাহসের কারনেই এরা শিকারের উদ্দেশ্যে হাতির উপর আক্রমন করে। যদিও বেশীর ভাগ সময়
এরা ব্যার্থ হয়। কারন হাতির আকার এবং শক্তির কাছে এরা একেবারেই তুচ্ছ।
আফ্রিকান বন্যকুকুরগুলো বড় হাতি শিকার করতে না পারলেও এরা সদ্যজাত হাতির বাচ্চাকে শিকার করতে পারে। হাতির নবজাতক বাচ্চাকে টার্গেট করে এরা চর্তুমুখী আক্রমন করে। এতে সদ্যজাত হাতির বাচ্চা বিভ্রান্ত হয়ে বন্যকুকুরের শিকারে পরিনত হয়।
০৩. হায়েনা
একদল হায়েনা হাতির বাচ্চাকে মেরে তার মাংস খাচেছ |
তবে সব সময় অন্যের শিকারের উপর নির্ভর না হয়ে মাঝে মাঝে এরা সরাসরি
শিকারে অংশ নেয়। আফ্রিকান স্পটেড হায়েনাগুলো শিকারের ক্ষেত্রে অনেক ভয়ংকর। বড়
শিকারের ক্ষেত্রে এরা শিকারের বাচ্চাকে টার্গেট করে দলবদ্ধভাবে আক্রমন করে।
হায়েনা বড় হাতিকে শিকার করার চেষ্টা করে না। তবে গর্ভবতী হাতিবাচ্চা প্রসব করার সময় এরা দূরে থেকে তা পর্যবেক্ষন করে। সুযোগ পেলে এরা সদ্যজাত
হাতির বাচ্চাকে চিনিয়ে নিয়ে যায়। এছাড়াও হাতির পালের দুর্বল, আকারে ছোট এবং অসুস্থ
হাতিদের এরা টার্গেট করে আক্রমন করে। দলবদ্ধ হায়েনার কাছে এই ধরনের হাতিগুলো
শিকারের জন্য আদর্শ শিকারী।
০৪. কুমির
কুমির বেশীরভাগ সময় পানিতে থাকে এবং হাতি বেশীরভাগ সময় স্থলে থাকে। তাই কুমিরের সাথে হাতির দেখা হওয়ার সুযোগ কম। এছাড়াও কুমির উভচর এবং হাতি চতুষ্পদী স্তন্যপায়ী হওয়ায় কুমির দ্বারা হাতি শিকার প্রায় অসম্ভব। তারপরেও হাতি শিকারীদের তালিকায় কুমিরের নাম রাখা যায়। কারন হাতি যখন পানি পান করার জন্য নদীর পাড়ে আসে তখন কুমির হাতির বাচ্চাদের শুড় ধরে টেনে পানিতে নিয়ে যায়।
একটি কুমির বাচ্চা হাতিকে আক্রমন করতে গিয়ে মা হাতির শূড়ে কামড় বসিয়েছে |
যদিও প্রাপ্ত বয়স্ক হাতিদের এইভাবে শিকার করা প্রায় অসম্ভব এবং একই সাথে নিশ্চিত মৃত্যূর সম্ভাবনা থাকে। মাঝে মাঝে কুমির ভুলবশত প্রাপ্তবয়স্ক হাতির শুড়েও কামড় বসায়। এতে হাতি রাগান্বিত হয়ে কুমিরকে পা দিয়ে চেপে ধরে মেরে ফেলে।
০৫. মানুষ
হাতির সবছেয়ে বড় শিকারী হচ্ছে মানুষ। প্রতি বছর মানুষ দ্বারাই সবছেয়ে বেশী হাতি শিকার হয়। মানুষ মূলত দুইটি কারনে হাতি শিকার করে।
ক) চোরাকারবারীর উদ্দেশ্যে
খ) হাতি ও মানুষের সংঘাত
চোরাকারবারীর উদ্দেশ্যে হাতি শিকারঃ
সেই প্রাচীনকাল থেকে হাতির দাঁত সৌখিন তৈষজপত্র, মূর্তি, এবং গহনা তৈরীতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যার ফলে হাতির দাঁতের মূল্য ও চাহিদা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে হাতির দাঁতের ক্রয় বিক্রয় নিষিদ্ধ। কিন্তু অত্যাধিক দাম থাকায় চোরাকারবারীরা প্রতিনিয়ত হাতি হত্যা করে দাঁত সংগ্রহ করছে।
একটি গবেষনায় দেখা যায়, প্রতি বছর, আনুমানিক ৫০০ মেট্রিক টন শিকার করা হাতির দাঁত আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার হয় চোরাকারবারীদের হাত ধরে।
টাইম ফর কিড্সের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০১২ সালে গোটা আফ্রিকা জুড়ে বেআইনি ভাবে ৩০ হাজার হাতিকে হত্যা করা হয়েছিল। হাতির দাঁতের রমরমা বাণিজ্যির কারনে ১৯৮০ সালে এক মিলিয়নের মতো হাতিকে শুধুমাত্র দাঁতের জন্য হত্যা করা হয়।
হাতি ও মানুষের সংঘাত
হাতিরা সাধরনত লাজুক প্রকৃতির হয়। তাই তারা সচারচর মানুষ্য বসতির আশে পাশে আসে না। এরা বনে জঙ্গলে গাছের আড়ালেই থাকতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ক্রমবর্ধমান মানুষের বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়ত বন উজাড় হচ্ছে ফলে হাতির তথা সকল বন্য প্রনীদের আবাসস্থলের পরিমান হ্রাস পাচ্ছে। একই সাথে বন কেটে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করায় হাতির খাদ্যের সংকট দেখা দিচ্ছে। যার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ান হাতি বন থেকে বের হয়ে লোকালয়ে আসা শুরু করেছে এবং মানুষের ফসলের মাঠে হামলা করছে। হাতির আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৃষকেরা নানা রকম ফাঁদ তৈরী করছে যাতে আটকা পড়ে প্রতি বছর অনেক হাতি মারা যাচেছ।
হাতিরা অনেক আবেগপ্রবন প্রানী। যার ফলে দলের একটি হাতি মারা গেলে বাকিরা আক্রমনাত্বক হয়ে উঠে এবং মানুষের উপর হামলা করে। আত্নরক্ষার চেষ্টায় মানুষ হাতি হত্য করে। ফলে হাতি এবং মানুষের সংঘাত প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৫০ বছরে মানুষ সৃষ্ট নানা কারনে অর্ধেকেরও বেশী এশিয়ান হাতির বিলুপ্ত ঘটেছে।
০৬. বাঘঃ
আফ্রিকা অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা না গেলেও এশিয়া অঞ্চলে বাঘ দেখা যায়। তাই
আফ্রিকান হাতি বাঘ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকলেও এশিয়াটিক হাতি
বাঘ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদিও বাঘ সচারচর হাতি শিকার করে না। কারন
বাঘ একাকী প্রানী। আর একাকী একটি হাতি শিকার করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবে একটি
পূর্ণ বয়স্ক বাঘের পক্ষে বাচ্চা হাতি শিকার করা একেবারেই সহজ।
বন্য পরিবেশে বাঘ দ্বারা কি পরিমান বাচ্চা হাতি শিকার হয়েছে তার সঠিক
কোন তথ্য না থাকলেও ভারতে বাঘ দ্বারা দুইটি পূর্ণ বয়স্ক হাতি শিকারের রেকর্ড
রয়েছে।
২০১১ সাল এবং ২০১৪ সালে ভারতের Kaziranga National Park এ রয়েল বেঙ্গল টাইগার দ্বারা প্রাপ্ত বয়স্ক দুটি হাতি হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
০৭. সাপ
অজগর কিংবা এনাকোন্ডার মতো বিশাল আকারের সাপ হাতি শিকার করে না। আবার ছোট আকারের সাপও খাবারের উদ্দেশ্যে হাতি শিকার করে না। তবে আফ্রিকার ছোট আকারের বিষাক্ত সাপগুলোর কামড়ে হাতির মৃত্যু হতে পারে। সাপ মূলত হত্যার উদ্দেশ্যে হাতির উপর আক্রমন করে না। তবে আক্রান্ত হলে কিংবা ভয় পেলে এরা হাতিকে কামড় দেয়। এরফলে বিষক্রিয়া অনেক সময় হাতি মারা যায়।