বন্য প্যালাস বিড়ালের (Pallas’s Cat) সাথে পরিচিত হয়ে নিন
প্যালাস একটি ছোট আকারের বন্য বিড়াল। চ্যাপ্টা গোলাকার মুখ, স্টকি বিল্ড শরীর এবং লম্বা ও পুরু পশমের এই ছোট বিড়ালটি তাদের বিখ্যাত চেহারার জন্য পরিচিত।
প্যালাস বিড়াল |
প্যালাস বিড়াল ইংরেজিতে Pallas's cat বা মানুল (manul) নামে পরিচিত। ১৭৭৬ সালে জার্মান প্রাণীবিদ
পিটার প্যালাস সর্বপ্রথম এই বিড়ালটি আবিস্কার করেন। এর এই বিড়ালের চ্যাপ্টা মুখ, শক্তিশালী
শরীরের গঠন এবং লম্বা পশমের কারনে পিটার প্যালাস
প্রাথমিকভাবে এই বিড়ালকে গৃহপালিত পারস্য বিড়ালের পূর্বপুরুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তার নাম অনুসারেই
এর নামকরন করা হয়েছে Pallas's cat. পিটার
প্যালাস এই বিড়ালের বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছেন ফেলিস মানুল (Felis manul)
হিসেবে। যেখানে মানুল মঙ্গোলিয়ান ভাষা থেকে আগত। বর্তমানে এর বৈজ্ঞানিক নাম Otocolobus
manul. যেখানে Otocolobus শব্দটি গ্রীক ভাষা থেকে এসেছে যার অর্থ ”কুৎসিত
কানওয়ালা”।
আরো পড়ুন- বিড়াল সম্পর্কে ২০টি মজার তথ্য যা জানলে আপনি অবাক হবেন
প্যালাস বিড়ালের আকার আকৃতিঃ
প্যালাস বিড়ালের চেহারা চ্যাপ্টা এবং শরীরের গঠন মজবুত ও শক্তিশালী। ওজন ৫-৯ পাউন্ড। প্রাপ্ত বয়স্ক প্যালাস বিড়ালের দৈর্ঘ্য মাথা থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত ১৯.৫-২৫.৫ ইঞ্চি। লেজের দৈর্ঘ্য ৮-১২ ইঞ্চি। এদের কোটের রং হালকা ধূসর এবং ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের। মাথার পাশে দুটি কালো রেখা রয়েছে। এদের লেজে চারটি কালো রিং থাকে। এদের কোট অনেক লম্বা এবং ঘন। পশমের ডগা সাদা এবং কালো বর্ণের হতে পারে। ভারী ও লম্বা কোট এদের শরীরকে শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা করে। হলুদ আভা যুক্ত কানের পিনে সাদা চুল রয়েছে। কান ছোট এবং গোলাকার। চোখের নিচ থেকে গালের উপর ছড়ানো কালো রঙ্গের ডোরাকাটা দাগ রয়েছে।
ঋতুভেদে এদের পশমের ঘনত্ব ও দৈর্ঘ্য হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। শীতকালে পশমের ঘনত্ব ও দৈর্ঘ্য সবছেয়ে বেশী থাকে। শীতকালে এদের পশম ধূসর রঙ্গের থাকলেও গ্রীষ্মে পশমের রং হয় ডোরাকাটা গেরুয়া রঙ্গের।
পা খাটো এবং শিকার উপযোগী নখর যুক্ত। এদের লম্বা ও পুরু পশমের কারনে এদের অনেক বড় দেখালেও বাস্তবে এরা গৃহাপালিত বিড়ালের মতোই একই আকারের। তবে গৃহপালিত হাইব্রিড ও বড় জাতের বিড়ালগুলোর তুলনায় ছোট। এদের শরীরে মোটা ও পুরু পশমের আবারণ এদের বন্য পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। মোটা ও লম্বা পশম এবং ভারী পশমে আবৃত লেজ এদের শরীরকে শীতের হাত থেকে রক্ষা করে। চোখের নিক্টিটেটিং মেমব্রেন ঠান্ডা বাতাস এবং ধূলোর হাত থেকে চোখকে রক্ষা করে। ছোট শরীর এবং পশমের রং এদের পাহাড় কিংবা তৃনভূমিতে আড়াল করতে সাহায্য করে।
প্যালাস বিড়ালের আবাসস্থল এবং প্রাপ্তিস্থানঃ
কম বৃষ্টিপাত, কম তুষারপাত, কম আদ্রতা সম্পন্ন ঠান্ডা শুষ্ক তৃনভূমি, পাহাড়ি পাথুরে অঞ্চল ও উপত্যাকার বাস্তুতান্ত্রিক এলাকায় এরা বাস করে। পাথরের খাজে, ছোট ছোট গর্তে কিংবা তৃনভূমির শুষ্ক স্থানে ছোট গর্তে এরা বাস করে।
Pallas's Cats |
প্যালাস বিড়ালগুলোর নিজস্ব পরিসীমা লিঙ্গভেদে পরিবর্তিত হয়। একটি মহিলা প্যালাস বিড়ালের নিজস্ব এলাকার বিস্তৃতি ৭-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত অপরদিকে একটি পুরুষ প্যালাস বিড়ালের নিজস্ত এলাকার বিস্তৃতি ২৩ কিলোমিটার পর্যন্ত। প্রতি ১০০ কিলোমিটারে ৪-৬টি প্যালাস বিড়াল থাকতে পারে। এর অধিক হলে আগে থেকেই ঐ অঞ্চলে বাস করা প্যালাস বিড়ালগুলো তাকে তাড়িয়ে দেয়।
শিকারের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে প্যালাস বিড়ালগুলোর আবাস্থল পরিবর্তন ঘটে। প্যালাস বিড়ালগুলোর প্রধান ও প্রিয় খাবার হচ্ছে পিকা (pikas) এবং ভোল (voles)। কোন অঞ্চলে এই প্রানীগুলোর আধিক্য থাকলে সেই অঞ্চলে প্যালাস বিড়াল প্রচুর দেখা যায়। আবার এইগুলোর পরিমান হ্রাস পেলে প্যালাস বিড়ালের উপস্থিতিও হ্রাস পায়। যার কারনে প্যালাস বিড়ালগুলোর আবাসস্থলের বিস্তৃতি বিরাট এলাকা জুড়ে।
আরো পড়ুন- বিড়ালের নয়টিচমৎকার বিশ্ব রেকর্ড যা আপনার অজানা
প্যালাস বিড়ালের আচরণঃ
প্যালাস বিড়ালগুলো একাকী প্রানী এবং আঞ্চলিক। অর্থাৎ প্রতিটি প্যালাস বিড়ালের একটি নিজস্ব বিচরণ এলাকা রয়েছে। এই বিড়ালগুলো দুই থেকে তিন মাইল পর্যন্ত গন্ধ দ্বারা নিজেদের উপস্থিতি অন্যকে জানান দিতে পারে।
আকারে ছোট হওয়া স্বত্তেও এই বিড়ালগুলো অন্য বন্য বিড়ালের মতোই আক্রমনাত্বক। উত্তেজিত হলে এরা গর্জন শুরু করে। তবে অন্যান্য বিড়ালের মতো এরা খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে না। তাই বিপদে পড়লে এরা আশেপাশের পাথরের ছোট খাঁজে আশ্রয় নেয়।
শিকার এবং খাদ্যঃ
প্যালাস বিড়াল মাংসাসী স্তন্যপায়ী প্রানী। এরা কাঠবিড়ালী, চুঁচো, পিকা (ইঁদুর জাতীয় একধরনের ছোট প্রানী), ভোল, চফ, ছোট খরগোশ, পাখি, কীট পতঙ্গ এবং বিটল খেয়ে থাকে। পিকা (Pika) এবং ভোল (Vole) প্যালাস বিড়ালের প্রধান খাদ্য। এদের খাবারের ৫০% এর বেশী থাকে পিকা। কখনো কখনো এরা মাছও খেয়ে থাকে।
এরা দিনের বেশীর ভাগ সময় ঘুমায় এবং রাত্রে শিকার করতে বের হয়। সচারচর এরা সন্ধ্যা এবং ভোরে শিকার করে। এরা তিন পদ্ধতিতে শিকার ধরে থাকে।
০১. শিকারের চলাচল অনুসরন করে শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে শিকার মেরে ফেলে।
০২. শিকারের গর্তের সামনে লুকিয়ে অপেক্ষা করা। শিকার গর্ত থেকে বের হলেই শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে শিকার করে।
০৩. গর্ত ছোট হলে শক্তিশালী থাবা দিয়ে গর্ত খনন করে শিকার বের করে নিয়ে আসে।
প্যালাস বিড়াল |
প্রজননঃ
প্যালাস বিড়ালের প্রজনন কালীন আচরণ গৃহপালিত বিড়াল থেকে একটু ভিন্ন। প্যালাস বিড়ালগুলো নয় থেকে দশ মাস বয়সে যৌন পরিপক্কতা অর্জন করে। ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পুরষ ও স্ত্রী প্যালাস বিড়ালগুলো যৌন মিলনের জন্য একে অপরের কাছে আসে। প্যালাস বিড়ালগুলো বহুগামী। অর্থাৎ একটি স্ত্রী বিড়াল প্রজনন মৌসুমে একাধিক বিড়ালের সাথে সঙ্গম করে থাকে। প্রজননকালে একটি পুরুষ বিড়াল স্ত্রী বিড়ালকে কয়েকদিন ধরে টানা অনুসরণ করে থাকে অন্য পুরুষ বিড়াল থেকে রক্ষা করার জন্য। স্ত্রী বিড়ালকে পাওয়ার জন্য এই সময় একাধিক পুরষ বিড়ালের মাঝে লড়াইও হতে পারে।
গর্ভকালীন সময় ৬৫-৭৫ দিন। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বাচ্চা জন্মানোর সময়। প্রতিটি লিটারে ১-৬টি বাচ্চার জন্ম হয়। তবে বেশীর ভাগ সময়ই তিন থেকে চারটি বাচ্চার জন্ম হয় একসাথে। সদ্যজাত বিড়ালের বাচ্চাগুলোর পশমের রং হয় কিছুটা কালো রঙ্গের যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিবর্ণ হয়ে যায়। বাচ্চা বিড়ালগুলো চোখ খোলার আগেই মৃদু গর্জন করতে পারে। দুই মাস বয়সে তাদের শরীরে স্বাভাবিক পশম দেখা যায়। এই সময় এদের ওজন হয় ৫০০-৬০০ গ্রাম। প্যালাস বিড়ালের বাচ্চাগুলো ৪-৫ মাস মায়ের সাথে কাটায়। এই সময় এরা শিকার ধরার ও টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ব করে। এরপর এরা আলাদা হয়ে স্বাধীন জীবন যাপন করে।
আয়ুষ্কালঃ
বন্য প্যালাস গুলো আয়ুষ্কাল সম্পর্কে কোন ধারনা না থাকলেও বন্ধী দশায় ১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। প্যালাস বিড়ালগুলোর মৃত্যুহার বেশী। ৬৮% বিড়াল ছানা প্রাপ্ত বয়ষ্কে আসার আগেই মৃত্যু বরণ করে। প্রাপ্ত বয়স্কদের মৃত্যু হার প্রায় ৫০%। অক্টোবর এবং এপ্রিল মাসে এদের মৃত্যুর হার বেশী।
জনসংখ্যাঃ
আইইউসিএন রেড লিস্ট অনুসারে, সারা পৃথিবীতে বর্তমানে ১৫,৩১৫টি প্রাপ্তবয়স্ক প্যালাস বিড়াল রয়েছে। এই প্রজাতির বিড়াল দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে IUCN প্যালাস বিড়ালক রেড লিস্টের ন্যূনতম উদ্বেগ (Nearly Threatened) হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে আধুনিকায়নের দ্রুত প্রসারের ফলে বন্য পরিবেশে এই বিড়ালটি অচিরেই হারিয়ে যাওয়ার শংকা রয়েছে।
প্যালাস বিড়ালগুলোর আয়ুস্কাল ও সংখ্যা হ্রাসের কারন সমূহঃ
বন্যপরিবেশের প্যালাস বিড়ালগুলোর সংখ্যা প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। এর কয়েকটি কারন থাকতে পারে যা নিম্নরূপ-
০১. শীতের সময় খাবারের সংকট বেশী দেখা যায়। যার ফলে এরা খাদ্যের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে বড় ঈগল এবং লাল শিয়াল দ্বারা এরা সহজেই শিকার হয়।
০২. কৃষকের ফসল রক্ষার জন্য নানারকম কৌশল অবলম্বন করায় পিক ও ভোলের সংখ্যা হ্রাস পায়। যেমন ফসলের মাঠে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পাতা, কীটনাশক ব্যবহার করায়।
০৩. গবাদি পশু দ্বারা চারনের এলাকা বিস্তৃতি ঘটায় এবং বনভূমিকে কৃষি জমিতে পরিনত করায় এদের আবাস্থল ও খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারন করেছে। একই সাথে ফসলের মাঠে পেঁচার উপস্থিতি বেড়ে গেলে এদের খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। কারন পেঁচা ইঁদুর শিকার করে খেয়ে ফেলে।
০৪. মানুষ পশম ও চামড়ার জন্য প্যালাস বিড়াল জন্য শিকার করে। যদিও বর্তমানে প্যালাস বিড়ালের চামড়া বিক্রি নিষিদ্ধ।
০৫. স্থানীয় আধিবাসীরা গৃহপালিত কুকুর লেলিয়েও এদের হত্যা করা হয়।
০৬. সভ্যতার অগ্রগতির তাগিদে বনভূমি উজাড় এবং নিত্য খনিজ সম্পদ খোজার চেষ্টা অন্যান্য বন্যপ্রানীর ন্যায় প্যালাস বিড়ালের আবাসস্থলের চরম সংকট সৃষ্টি করেছে।
০৭. মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়াতে এক বিশেষ ধরনের ঔষদ তৈরীতে প্যালাস বিড়ালগুলো ব্যবহার করা হয়।
সংরক্ষন অবস্থাঃ
প্যালাস
বিড়াল সংরক্ষনের জন্য যেসব দেশে প্যালাস বিড়াল পাওয়া যায় সেইসব দেশের স্থানীয় প্রতিনিধি সহ আর্ন্তজাতিক প্রায়
৩০ জন সদস্য নিয়ে
২০১২ সালে গঠিত হয় ”প্যালাস ক্যাট ওয়ার্কিং গ্রুপ” সংক্ষেপে
PCWG. এর মূল
লক্ষ হলো প্যালাস বিড়াল সম্পর্কে অধ্যায়ন এবং সংরক্ষন।
২০১৬
সালে স্কটল্যান্ডের রয়্যাল জুলজিক্যাল সোসাইটি, সুইডেনের নর্ডেন্স আর্ক চিড়িয়াখানা এবং স্নো লেপার্ড ট্রাস্টের সহযোগিতায় গঠিত হয় Pallas’s cat
International Conservation Alliance সংক্ষেপে PICA গঠিত হয় এর মূল
উদ্দেশ্য হচ্ছে প্যালাস বিড়ালের উপর জরিপ করা, মৌলিক বাস্তুসংস্থানের উপর জ্ঞান বৃদ্ধি সহ সচেতনতা এবং
একটি সংরক্ষন কর্মপরিকল্পনা তৈরী করা।
১৯৫০
সাল থেকে চিড়িয়াখানায় রেখে এদের প্রজনন কর্মসূচি চালু রয়েছে। বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে ৬০টি চিড়িয়াখানায় এদের প্রজনন কার্যক্রম চালু রয়েছে। চিড়িয়াখানায় বন্দী অবস্থায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৭৭টি প্যালাস বিড়াল রয়েছে।
শেষ কথাঃ
আমাদের এই পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করার জন্য সৃষ্টিকর্তা অনেক উপাদান দিয়েছেন। আমরা আমাদের স্বার্থে সেই উপাদানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলছি। যা এই পৃথিবীর জন্য হুমকি স্বরূপ। এই পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে তোলার জন্য প্রতিটি প্রানীকেই টিকিয়ে রাখতে হবে। প্যালাস বিড়ালকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের সকলকে সচেষ্ট হতে হবে।
আরো দেখুন