মেরু ভালুকের আবাসস্থল, অভিযোজন, খাদ্যাভ্যাস, প্রজনন এবং শিকার
মেরু ভালুকের আবাসস্থল
নামের শুরুতে মেরু শব্দটা থাকায় সহজেই বুজা যায় মেরু ভালুক মেরু অঞ্চলে পাওয়া যায়। পৃথিবীর উত্তর অংশের শীতলতম স্থানেই মেরু ভালুক দেখা যায়। আর্কটিক সমুদ্রের বরফ, নরওয়ে, রাশিয়া, গ্রিনল্যান্ড, আমেরিকার আলাস্কা, কানাডার উপকূলে মেরু ভালুক বাস করে। মেরু ভালুকের ১৯টি উপ-প্রজাতি রয়েছে।
পৃথিবীর পাঁচটি দেশজুড়ে মেরু ভালুক দেখা যায়। কিন্তু তাদের সংখ্যা কতো তার কোন সঠিক হিসেব নেই। কারন মেরু অঞ্চলের বৈরী আবহাওয়ার কারনে তাদের সঠিক সংখ্যা গননা করা প্রায় অসম্ভব। তবে জীববিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীজুড়ে মেরু ভালুকের সংখ্যা ২৩০০০-২৬০০০ বলে মনে করেন। মজার ব্যাপার সারা পৃথিবীর সব মেরু ভালুকের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই বাস করে কানাডায়।
মেরু ভালুকের অভিযোজন
পৃথিবীর অন্যসব
অঞ্চলের তুলনায় আর্কটিক অঞ্চলের আবহাওয়া ভিন্ন। এখানে শীতকালে সূর্যের দেখা পাওয়া যায়
না। গ্রীষ্মকালে সূর্যাস্ত যায় না। শীতকালের গড় তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই
বরফের রাজ্যে মেরু ভালুক কিভাবে টিকে আছে? আর্কটিক বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রানী হচ্ছে মেরু ভালুক।
বরফের রাজ্যে
টিকে থাকার জন্য মেরু ভালুকের শরীর বিশেষ ভাবে অভিযোজিত হয়েছে। মেরু ভালুক কিভাবে
অভিযোজিত হয়েছে তা জানার আগে আমরা জেনে নিই আর্টিক/মেরু অঞ্চলে এই ভালুকগুলো কিভাবে
এসেছে?
ভালুক মেরু অঞ্চলে কিভাবে এসেছে?
মেরু ভালুক
বাদামী ভালুকের উত্তরসূরি। বাদামী ভালুকের এক অংশের বিবর্তিত রূপ হচ্ছে মেরু ভালুক।
প্লাইস্টোসিন হিমবাহের সময় সাইবেরিয়ান পূর্ব অংশ হতে একদল বাদামী ভালুক মূল দল হতে
বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা হয়ে যায়। বাদামী ভালুক খাবারের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়লে তাদের একটি
দল মূল দল হতে আলাদা হয়ে উত্তারাঞ্চলে আটকা পড়ে। বিশাল আকৃতির বরফ এবং তুষার দুইটি
দলকে আলাদা করে দিয়েছে।
উত্তরাঞ্চলের
হিমশীতল বরফে আটকা পড়া বাদামী ভালুকগুলো টিকে থাকার জন্য লড়াই শুরু করে। টিকে থাকার লড়াইয়ে যারা কিছু বিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পেরেছে তারাই টিকে গেছে বাকিরা মারা গেছে তীব্র শীতে।
২০০৪ সালে প্রিন্স চার্লস ফোরল্যান্ডে মেরু ভালুকের একটি জীবাষ্ম পাওয়া গেছে। জীবাষ্মটি ১,১০,০০০ বছর থেকে ১,৩০,০০০ বছর পুরানো চোয়ালের হাঁড়। যা এই পর্যন্ত পাওয়া মেরু ভালুকের জীবাষ্মের মধ্যে সবছেয়ে প্রাচীনতম। জীবাষ্ম বিশ্লেষন করে এবং ডিএনএ টেস্ট করে দেখা যায়, মেরু ভালুক ১,৫০,০০০ বছর আগে বাদামী ভালুক হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ১০০০০ থেকে ২০০০০ হাজার পূর্বে বাদামী ভালুকের মোলার দাঁতগুলো মেরু ভালুকের দাঁতের থেকে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। এথেকে গবেষকরা ধারনা করেন মেরু ভালুক হিমশীতল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ধীরে ধীরে তাদের শরীরে অভিযোজিত বৈশিষ্টিগুলো অর্জন করেছে। যা বর্তমানে একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে আমাদের কাছে স্বীকৃত।
মেরু ভালুকের অভিযোজিত বৈশিষ্ট্য
তুষারময় বরফের
সমুদ্রে টিকে থাকার জন্য মেরু ভালুকের বেশ কিছু অভিযোজন ঘটেছে। মেরু ভালুকের কিছু অভিযোজিত
বৈশিষ্ট্য নিম্ন রূপ-
০১. মেরু
অঞ্চলে বড় কোন বৃক্ষ নেই। চারদিকেই সাদা বরফের আস্তরন। যদিও গ্রীষ্মকালে সমভূমিতে গুল্ম
ও ঘাস গজায়। যাই হোক এই সাদা বরফের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে শিকার করা প্রায় অসম্ভব।
টিকে থাকতে হলে শিকার করতেই হবে। তাই বরফের আড়ালে নিজেদের আড়াল করার জন্যই মেরু ভালুকেরপশমের রং স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার হয়েছে যা আমাদের চোখে সাদা দেখায়। এতে করে মেরু ভালুক
প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূর থেকেই শিকারকে দেখতে পায় এবং বরফের আড়ালে লুকিয়ে শিকারের
কাছে চলে আসতে পারে।
আরো পড়ুন
মেরু ভালুকের পশমের রং সাদা দেখায় কেনো?
০২. মেরু
ভালুকের পশম দুই স্তর বিশিষ্ট্য, তৈলাক্ত এবং পানিরোধী। একটি আকারে ছোট এবং ঘন। আরেকটি
বড় এবং ফাঁফা নলের মতো। দুই স্তর বিশিষ্ট্য পশম হওয়ায় এরা সূর্যের তাপ বেশী ধরে রাখতে
পারে। এতে করে এদের শরীর গরম থাকে। আবার পশমগুলো পানিরোধী হওয়ায় পানিতে থাকলেও এদের
শরীর শীতল হয় না।
০৩. মেরু
ভালুকের চামড়ার রং কালো। যদিও অন্যসব ভালুকের চমড়ার রং গোলাফি। চামড়ার রং কালো মেরু
ভালুকের আরেকটি বির্বতিত বৈশিষ্ট্য। তীব্র শীতে শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখা এবং সূর্য
থেকে তাপ ধরে রাখার জন্য এদের চামড়ার এমন বিবর্তন হয়েছে।
০৪. মেরু
ভালুকের চামড়ার নিছে চার ইঞ্চি পুরু চর্বির আস্তরন থাকে। এই চর্বির আস্তরন এদের শরীরকে
গরম রাখে।
০৫. শীত থেকে
রক্ষা পাওয়ার জন্য এদের পুরো শরীর পশম দ্বারা আবৃত শুধুমাত্র নাক এবং পায়ের তালুছাড়া।
০৬. এদের
কান ও লেজ আকরে ছোট এবং পা শক্তিশালী ও মজবুত। তুষার কিংবা বরফের উপর হাঁটার সময় শরীরের
ভর ঠিক রাখা এবং পানিতে সাতার কাটার জন্যই এদের পা শক্তিশালী ও মজবুত হয়েছে। বাদামী
ভালুকের তুলনায় মেরু ভালুকের নখ ছোট কিন্তু মজবুত ও শক্তিশালী। নখগুলো নিছের দিকে স্কুভ
করা যাতে করে বরফ খনন করতে পারে।
০৭. মেরু ভালুকের মুখে শক্তিশালী ৪২টি দাঁত রয়েছে। মুখের
দাঁত বাদামী ভালুক থেকে আকারে ছোট।
০৮. মেরু
ভালুকের গন্ধ ইন্দ্রিয় চমৎকার ভাবে অভিযোজিত হয়েছে। এরা গন্ধ ইন্দ্রিয় অন্ত্যন্ত উন্নত
পর্যায়ের। মেরু ভালুক ১.৫ মাইল দূর থেকেও শিকারকে সনাক্ত করতে পারে। আবার ৩ফুট বরফের
নিছের সীলগুলোকেও সনাক্ত করতে পারে এদের উন্নত গন্ধইন্দ্রিয় দ্বারা।
০৯. অন্যান্য
স্তন্যপায়ীদের মতো মেরু ভালুকও প্রাকৃতিক ভাবে সাঁতারু। এরা ঘন্টায় দশ কিলোমিটার বেগে
সাঁতার কাটতে পারে।
১০. মেরু ভালুক বাদামী ভালুকের তুলনায় শান্ত। বিশাল মেরু এলাকার বরফের রাজ্যে থাকতে থাকতে এরা এই শান্ত স্বভাবটা অর্জন করেছে।
১১. মেরু ভালুকের মাথা এবং মুখ সরু ও লম্বা। শরীরের পিছনের অংশ আকারে বিশাল। মুখ ও মাথা সরু হওয়ার মূল কারন হচ্ছে বরফের গর্ত থেকে তাদের প্রধান শিকার সীলকে ধরে আনতে। সম্মুখ ভাগ সরু হওয়ায় সহজেই সীলের গর্তে মুখ ডুকিয়ে সীলের উপর কাঁমড় বসাতে পারে। পিছনের অংশ শক্তীশালী হওয়ায় সহজেই বিশাল আকারের সীল বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারে।
১২. মেরু ভালুক শিকার ধরার জন্য পানির নিচে তিন মিনিট পর্যন্ত সাঁতার কাটতে পারে এবং থাকতে পারে।
মেরু ভালুকের সামাজিক ও পারিবারিক আচরণ
পূর্বপুরুষ বাদামী ভালুক হিংস্র হলেও মেরু ভালুক শান্ত। এরা একেবারে বাধ্য না হলে মানুষের উপর আক্রমন করে না। যদিও মেরু অঞ্চলে মানুষের উপস্থিতি একেবারেই কম। তারপরেও মেরু ভালুক কর্তৃক মানুষকে আক্রমনের ঘটনা খুবই বিরল। যেখানে মানুষ বাদামী ভালুক দ্বারা নিয়মিত আক্রান্ত হয়।
মেরু ভালুকের খাদ্যাভ্যাস এবং শিকার
মেরু ভালুককে বলা হয় Hypercarnivore. এই শ্রেনীর প্রানীদের খাদ্য তালিকায় ৭০% থাকে মাংস। ভালুক প্রজাতিদের মধ্যে মেরু ভালুকই সবছেয়ে বেশী মাংসের উপর নির্ভর করে। মেরু ভালুকের প্রধান ও প্রিয় খাবার হচ্ছে রিং সিল এবং দাঁড়িওয়ালা সীল।
মেরু অঞ্চলে এই দুই ধরনের সীল প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। যেগুলো বরফের তৈরী গর্তে বাসা করে থাকে। এই সিলগুলো যখন নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বরফের গর্ত থেকে বের হয় কিংবা বিশ্রাম ও রোদ পোহানোর জন্য বরফের উপর উঠে তখনি মেরু ভালুক এদের শিকার করে।
পানি থেকে সরাররি সীল শিকার করা অনেক কঠিন কাজ। একেবারে বাধ্য না হলে মেরু ভালুক সরাসরি পানি থেকে সীল শিকার করতে যায় না। এরা শিকারের জন্য সীলের বাসার সামনে ওৎ ফেতে বসে থাকে। যখনি সীল বের হয় তখনি এরা সীলের উপর আক্রমন করে সীলের মাথার খুলি ভেঙ্গে ফেলে।
মেরু ভালুকের গন্ধ ইন্দ্রিয় অনেক উন্নত। এরা বরফের উপর থেকে সীলের নিঃশ্বাসের গন্ধ অনুসারে সীলের বাসা খুজে বের করতে পারে। সীলের বাসা খুজে ফেলে এরা এদের সরু মুখ দিয়ে সীলের বাসায় প্রবেশ করে এবং শক্তিশালী পশ্চাৎ অংশ এবং পা দিয়ে সীলকে টেনে বের করে নিয়ে আসে।
আরেক ধরনের শিকার করার পদ্ধতি হচ্ছে শিকারের চোখের আড়ালে লুকিয়ে একেবারে শিকারের কাছে চলে এসে শিকার করা। বিশেষ করে যখন সীলগুলো রোদ পোহানোর জন্য বরফের উপর উঠে বিশ্রাম নেয় তখনি মেরু ভালুক স্ক্রল করে একেবারে শিকারের ১০-১২ ফুটের মধ্যে চলে আসে। এরপর দ্রুত শিকারের উপর আক্রমন করে শিকারের মাথার খুলি ভেঙ্গে ফেলে।
মা সীলগুলো বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য বরফের উপর একধরনের বাসা বানায়। এগুলোকে বার্থ লেয়ারও বলা হয়। মেরু ভালুক তার শক্তিশালী পা দিয়ে এই লেয়ার ভেঙ্গে সীল শিকার করে।
রিং সীল এবং দাঁড়িওয়াল সীল আকারে ছোট হওয়ায় মেরু ভালুক সহজেই এদের শিকার করে খায়। এছাড়াও মেরু ভালুকের খাবারের তালিকায় রয়েছে Fourhorn Sculpin, Arctic char, Harp seal, Harbour Seal, Hooded Seal, Beluga Whales, Narwhals জাতীয় শিকার।
মেরু ভালুক সারা বছর ব্যাপী শিকার ধরে ও খায়। তবে গ্রীষ্মের শেষের দিকে এব শরৎ এর শুরুর দিকে যখন বরফ গলে যায় তখন শিকারের উপস্থিতি কম থাকে। এই সময় এরা কয়েক মাস না খেয়ে থাকতে পারে। তখন তার তাদের দেহের সঞ্চিত চর্বি গলিয়ে টিকে থাকে। এই ব্যাপারটা রেগুলার ঘটে না। যখনি খাবারের স্বল্পতা থাকে তখনি এরা এমন করে।
মেরু ভালুকের প্রধান খাবার হচ্ছে সামুদ্রিক সীল ও বিভিন্ন ধরনের মাছ। বৈশ্বিক উষ্ণয়ানের ফলে বরফ গলা শুরু হয়েছে। আর বরফের অনুপস্থিতির কারনে সীল শিকার করাও বেশ কঠিন মেরু ভালুকের জন্য। তাই সময়ের সাথে সাথে মেরু ভালুক তাদের খাবারের তালিকায়ও পরিবর্তন এনেছে। মেরু ভালুক এখন স্থলজ স্তন্যপায়ী, পাখি, ডিম, ঘাস ইত্যাদিও খেতে পারে।
এই তালিকায় রয়েছে Muskox, Reindeer এর মতো স্তন্যপায়ী প্রানী এবং তাদের বাছুর। এছাড়াও আর্টিক পাখি, রোডেন্টস, কাঁকড়া, চিংড়ি, বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ, ডিম, ঘাস, গুল্ম, লতা পাতা এবং শিকড়। খাবারের সংকট থাকলে এরা স্বপ্রজাতির মেরু ভালুকও শিকার করে খায়।
মেরু ভালুকে প্রজনন এবং জীবনচক্র
স্ত্রী মেরু
ভালুক চার থেকে পাঁচ বছর বয়সে প্রজননের উপযোগী হয়। পুরুষ মেরু ভালুক ছয় বছর বয়সে যৌন
পরিপক্কতা অর্জন করে। গর্ভকালীন সময়ে স্ত্রী মেরু ভালুক প্রায় আট মাস পর্যন্ত না খেয়ে
থাকতে হয়। এই সময় এরা এদের দেহে জমে থাকা চর্বির সাহায্যে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রবাহ বজায়
রাখে। তাই পাঁচ বছর বয়স হলেও দেহে প্রয়োজনীয় চর্বি এবং ওজন না থাকলে অনেক স্ত্রী মেরু
ভালুক গর্ভ ধারন করে না। আবার একজন স্ত্রীর জন্য একাধিক পুরুষ মেরু ভালুকের সাথে প্রতিযোগিতা
হয়। তাই ছয় বছর বয়সে যৌন পরিপক্কতা অর্জন করলেও আট দশ বছরের আগে পুরুষ মেরু ভালুক বংশবৃদ্ধি
করে না।
মেরু ভালুক একাকী প্রানী। এরা দলবদ্ধ ভাবে থাকে না। প্রজননের সময় পুরুষ মেরু ভালুক স্ত্রী মেরু ভালুকের ট্রাক অনুসরন করে কাছে আসে। একটি পুরুষ মেরু ভালুক ১০০ কিমি দূর থেকেও স্ত্রী মেরু ভালুকের ট্রাক অনুসরন করতে পারে।
এপ্রিল এবং
মে মাসে স্ত্রী মেরু ভালুক এবং পুরুষ মেরু ভালুকের মিলন ঘটে। স্ত্রী মেরু ভালুক বহুগামী।
অর্থ্যাৎ একটি স্ত্রী মেরু ভালুক প্রজননের সময় একাধিক পুরুষ মেরু ভালুকের সাথে সঙ্গমে
লিপ্ত হয়। মিলনের জন্য একাধিক পুরুষ মেরু ভালুক একে অপরের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। কখনো
কখনো এই লড়াই প্রানঘাতিও হয়ে উঠে। লড়াইয়ে জয়ী পুরুষ স্ত্রী মেরু ভালুকের সাথে মিলিত
হয় এবং কয়েক দিন তারা কাপল জীবন কাটায়।
গর্ভকালীন সময়ে স্ত্রী মেরু ভালুক প্রচুর খাবার খায়। যার ফলে এই সময় তাদের ওজন দ্বিগুন বৃদ্ধি পায়।শরৎকালে যখন বরফের স্তর কমে যায় তখন স্ত্রী মেরু ভালুক উপকূলের আশেপাশের ভূমিতে বরফ খুড়ে গর্ত তৈরী করে। কিছু কিছু স্ত্রী মেরু ভালুক ভূমির বরফে গর্ত না করে সরাসরি সমুদ্রের ভাসমান বরফে গুহা তৈরী করে বাসা বানায়। এই বাসাটা দুই থেকে তিন প্রকৌষ্ঠ বিশিষ্ট্য।
বাচ্চা জন্মের
পূর্বেই মা ভালুক এই বাসায় প্রবেশ করে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে মা ভালুক
এক থেকে দুইটি বাচ্চার জন্ম দেয়। জন্মের সময় বাচ্চাগুলো থাকে অন্ধ অর্থাৎ জন্মের সাথে
সাথেই মেরু ভালুকের বাচ্চার চোখ ফোটে না। জন্মের সময় একটি বাচ্চার ওজন এক কেজি বা তার
কিছুটা কম হতে পারে।
সন্তান জন্মের
পর মা মেরু ভালুক সন্তানদের নিয়ে ফেব্রুয়ারী মাস থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত গর্তে
থাকে। এই সময় মা মেরু ভালুক কোন খাবার গ্রহণ করে না। দেহের জমানো চর্বি পুড়িয়ে প্রয়োজনীয়
শক্তি গ্রহণ করে। বাচ্চারা মায়ের দুধ খায়। মায়ের দুধে চর্বির পরিমান অত্যাধিক থাকায়
বাচ্চারা দ্রুতই ওজনে বৃদ্ধি পায়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মা গুহার মুখের বরফ ভেঙ্গে
বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়। এই সময় বাচ্চাদের ওজন থাকে ১০-১৫ কিলোগ্রামের মতো। গর্তের মুখ
ভেঙ্গে বের হওয়ার পর মা তার শাবকদের নিয়ে আরো দশ বার দিন গুহার আশে পাশে কাটায়। এই
সময় বাচ্চাগুলো গুহার আশে পাশে খেলা করে সময় কাটায়। মা আশে পাশের ভূমির ঘাস ও গাছপালা
খেয়ে থাকে। দশ বার দিন পর বাচ্চারা যখন বাহিরের পরিবেশের সাথে সম্পূর্ণ মানিয়ে নেওয়ার
কৌশল আয়ত্ব করে তখন মা মেরু ভালুক বাচ্চাদের নিয়ে বরফের সমুদ্রের দিকে হাঁটা শুরু করে
যেখানে তাদের প্রিয় খাবার সীলের উপস্থিতি রয়েছে।
বাচ্চার আড়াই
বছর পর্যন্ত মায়ের সাথে থাকে। এই আড়াই বছর তারা মায়ের দুধ খায় একই সাথে শিকার ধরার
কৌশলগুলোও আয়ত্ব করে নেয়। আড়াই বছর বয়স হলে মা মেরু ভালুক তার সন্তানদের তাড়িয়ে দেয়
কিংবা সন্তানেরা আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র জীবন বেঁচে নেয়।
মাঝে মাঝে স্ত্রী মেরু ভালুকগুলো অন্য ভালুকের সন্তানকে দত্তক নিতে দেখা যায়। খাবারের সংকট থাকলে মেরু ভালুক স্বগোত্রীয় মেরু ভালুক কিংবা শিশু ভালুকগুলোকে হত্যা করে খায়। যদি কোন মা মেরু ভালুক অন্য মেরু ভালুক দ্বারা কিংবা অন্যকোন কারনে মারা যায় তখন আশে পাশের অন্য স্ত্রী মেরু ভালুক সেই সন্তানদের নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসে এবং সন্তানের মতো লালন পালন করে।
মেরু ভালুকের আয়ুস্কাল
বন্য পরিবেশে
মেরু ভালুকের গড় আয়ু ২৫-৩০ বছর। চিড়িয়াখানার বন্দী অবস্থায় মেরু ভালুক আরো বেশী বছর
বেঁচে থাকে। বন্দী অবস্থায় একটি স্ত্রী মেরু ভালুক ৪৩ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড
রয়েছে।
বন্য পরিবেশের
মেরু ভালুকের মৃত্যুর কারন সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য না থাকলেও ধারনা করা হয় বয়স বাড়ার
সাথে সাথে তারা শিকার ধরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন খাবারের অভাবে মারা যায়। প্রজননের
সময় মারামারি করেও কেউ মারা যায়। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগেও কেউ কেউ মারা যায়।
মেরু ভালুকের শিকারী
মেরু ভালুক
আর্কটিক অঞ্চলের সবছেয়ে বড় শিকারী হলেও তারা অন্য প্রানীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিশেষ
করে মেরু শিয়াল গুলো প্রায় সময় ভালুকের বাচ্চাগুলোকে শিকার করে। হাঙ্গর, নেকড়ে, বাদামী
ভালুক দ্বারও মেরু ভালুকের বাচ্চারা শিকার হয়।
প্রাপ্ত বয়স্ক
মেরু ভালুকের সবছেয়ে বড় শিকারী হচ্ছে মানুষ। মানুষ কুকুর দিয়ে মেরু ভালুকগুলোরে খুজে
বের করে এবং বল্লম কিংবা গুলি করে তাদের হত্যা করে। মূলত মেরু ভালুকের চামড়ার জন্যই
তাদের শিকার করা হয়ে থাকে। মেরু ভালুকের চামড়া দিয়ে শীত নিরোধক মূল্যবান পোষাক তৈরী
হয়। এছাড়াও তাদের পশম দিয়ে কার্পেট সহ অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিস তৈরী হয়।
মেরু ভালুকের
দাঁত দিয়ে তাবিজ এবং গহনা তৈরী হয়। এছাড়াও মেরু ভালুকের শরীরের চর্বি দিয়ে জ্বালানি
তৈরী করা হয় এবং মাংস খাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। হৃৎপিন্ড ও পিত্তথলি শুকিয়ে গুড়ো
করে তা ঔষদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মূলত এইসব বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই মানুষ মেরু ভালুক
শিকার করে।
মানুষ কর্তৃক মেরু ভালুক শিকার কারনে এদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মেরু ভালুকের শিকার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। কানাডা সরকরা ১৯৬৮ সালে, নরওয়ে সরকার ১৯৭৩ সালে মেরু ভালুক শিকার নিষিদ্ধ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী সুরক্ষা আইন প্রনয়ন করে। ১৯৭৩ সালে মেরু ভালুক পাওয়া যায় এমন পাঁচটি দেশ কানাডা, ডেনমার্ক,নরওয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলে মেরু ভালুক সংরক্ষন চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে। যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মেরু ভালুক সংরক্ষন এবং শিকার নিষিদ্ধ করন। বর্তমানে ডেনমার্কে মেরু ভালুক শিকার করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
আরো পড়ুন মেরু ভালুকের পশমের রং সাদা হলো কি ভাবে?