রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বৈশিষ্ট্য, আকৃতি, বাসস্থান, প্রজনন ও খাদ্যভ্যাস

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবি
বেঙ্গল টাইগার

বিড়াল প্রজাতির মধ্যে আকারে সবছেয়ে বড় প্রজাতি হলো বাঘ প্রজাতি। বাঘের ইংরেজী নাম Tiger স্ত্রী বাঘকে বলা হয় Tigress  প্রানী জগতে কর্ডাটা পর্বে এদের অবস্থান। বাঘের বৈজ্ঞানিক নাম Panthera Tigris

বর্তমানে সারা পৃথিবীতে নয় ধরনের বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায় যার মাঝে ছয় ধরনের বাঘ বর্তমানে জীবিত আছে বাকি তিন ধরনের বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই নয় ধরনের বাঘই একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন উপপ্রজাতি। তেমনি বাঘের একটি উপ-প্রজাতি হচ্ছে বেঙ্গল টাইগার।

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পরিচিতিঃ

বাংলাদেশের জাতীয় বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার যা সারা বিশ্বে বেঙ্গল টাইগার বা ইন্ডিয়ান টাইগার নামেও পরিচিত। বেঙ্গল টাইগারের বৈজ্ঞানিক নাম Panthera Tigris Tigris    বেঙ্গল টাইগার ভারতীয় উপমাদেশের স্থানীয় অর্থাৎ বন্য পরিবেশে ভারতীয় উপমহাদেশ ব্যাতীত এদের আর কোথায় দেখা যায় না। ICZN এর তথ্য অনুসারে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিপন্ন প্রানী। সারা পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ২,৬০০ থেকে ৩,০০০ এর মতো রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রং

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গায়ে উজ্জ্বল হলুদ থেকে হালকা কমলা রঙ্গের লোম থাকে।এদের গায়ে যে ডোরাকাটা থাকে তা হয় উজ্জ্বল কালো কিংবা গাঢ় খয়েরি। পেটের দিকের লোমের রং সাদা। লেজের অংশ হয় কালো রং এর। এই কালো রং এর উপর রিং আকৃতির সাদা দাগ থাকে যা তাদের লেজকে সৌর্ন্দয মন্ডিত করে তোলে।

এছাড়াও সাদা রং এর বেঙ্গল টাইগার দেখা যায়। এগুলো বন্যপরিবেশে দেখা যায় না। তবে রির্জাভ এরিয়া কিংবা চিড়িয়াখানায় এদের উপস্থিতি রয়েছে যদিও সংখ্যা খুবই কম। ধারনা করা হয় জেনেটিক মিউটেশনের কারনে এদের গায়ের রং পরিবর্তিত হয়েছে। সাদা বাঘের গায়ের লোমের রং সাদার উপর বাদামী  রঙ্গের ডোরাকাটা রয়েছে।

এছাড়াও কালো বর্ণের বাঘের চাড়মা চোরাকারবারীদের নিকট হতে উদ্ধার করা হলেও বাস্তাবে কালো বর্ণের বাঘের উপস্থিতির কোন রেকর্ড নেই। একসময় ভারতের উড়িষ্যা, বিহার, আসাম এবং মধ্য প্রদেশের রেওয়া এলাকায় সাদা বাঘের উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও বর্তমানে এইসব অঞ্চলে সাদা বাঘ আর দেখা যায় না।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর আকার আকৃতি

ভারতের বেঙ্গল টাইগারদের শরীর লম্বায় -. ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে তিনফুটের মতো হয়ে থাকে। সবছেয়ে লম্বা বাঘের রেকর্ড রয়েছে ১২. ফুট পর্যন্ত। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরষ বেঙ্গল টাইগার স্ত্রী বেঙ্গল টাইগারের ছেয়ে আকার ওজনে বেশী হয়। পুরষ বাঘের ওজন গড়ে ২২৭ থেকে ২৩০ পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং স্ত্রী বাঘের ওজন গড়ে ১১৬-১৬৪ কেজি পর্যন্ত।

তবে বাংলাদেশের সুন্দরবনে পাওয়া রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ওজন তুলনামূলক ভাবে ভারতে পাওয়া বেঙ্গল টাইগারের ছেয়ে কম হয়। আবার বন্য পরিবেশে বেঙ্গল টাইগার আকারে সবছেয়ে বড় হয়। তবে খাঁচায় সাইবেরিয়ান বাঘগুলো আকারে বেঙ্গল টাইগারের ছেয়েও বড় হয়।

ভারতের চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্কের একটি পুরুষ বাঘ পাওয়া গেছে যার ওজন ছিলো ২৭০ কেজি বা ৬০০ পাউন্ডের মতো। যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা বাঘদের ওজনের মধ্যে সবছেয়ে বেশী।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার কোথায় বাস করেঃ

রয়েল বেঙ্গল টাইগার ভারতীয় উপমহাদেশের এন্ডোমিক বা স্থানীয় প্রানী। বন্য পরিবেশে এগুলো শুধুমাত্র ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটানেই পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের যেসব অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাস করে তার তথ্য নিছে দেওয়া হলো।

ভারতের যেসব অঞ্চলে বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়ঃ 

বন্য পরিবেশে বেঙ্গল টাইগার ভারতের সুন্দরবন অংশে ভারতের গ্রীষ্মমন্ডলীয় আর্দ্র চিরহরিৎ বন, গ্রীষ্মমন্ডলীয় শুষ্ক বন, গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় আর্দ্র পর্ণমোচী বন, ম্যানগ্রোভ, উপক্রান্তীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ উচ্চভূমি বন এবং পলিমাটিযুক্ত  তৃণভূমিতে দেখা যায়। 

ভারতের হাজারীবাগ ন্যাশনাল পার্ক, নামদাফা ন্যাশনাল পার্ক , মেলঘাট টাইগার রিজার্ভ, পান্না ন্যাশনাল পার্ক, রাতাপানি টাইগার রিজার্ভ, উড়িষ্যার শুষ্ক বন এবং কানহা-ইন্দ্রাবতী করিডোরের নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল জুড়ে বেঙ্গল টাইগারদের দেখা যায়। এছাড়াও বান্দিপুর, পারম্বিকুলম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, পশ্চিমঘাট এবং কালাকাদ-মুন্ডাথুরাই, নাগার্জুন সাগর-শ্রীশাইলম টাইগার রিজার্ভ, পান্না ন্যাশনাল পার্ক, মেলঘাট টাইগার রিজার্ভ এবং কানহা-পেঞ্চ, কাজিরাঙ্গা-মেঘালয়, সিমলিপাল ইন্দ্রাবতী বাঘ সংরক্ষন ইউনিট, পারম্বিকুলম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, পেরিয়ার এবং বান্দিপুর বাঘ সংরক্ষন ইউনিটে বেঙ্গল টাইগারদের দেখা যায়। 

তবে বাঘের সংখ্যা তুলমামূলক ভাবে হ্রাস পাওয়ায় ভারত সরকার প্রায় ১৫৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বাঘ সংরক্ষনের উদ্দ্যোগ গ্রহণ করে। যার অংশ হিসেবে ভারতে অনেকগুলো বাঘ সংরক্ষন ইউনিট (Tiger Conservation Units, TCUs) রয়েছে। ২১টি রাজ্য নিয়ে ভারতে প্রায় ৫০টি বাঘ সংরক্ষনের জন্য রির্জাব এলাকা রয়েছে যার আয়তন প্রায় ৭২,০০০ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে। ভারত সরকার এবং জনগনের ভূমিকায় বর্তমানে ভারত হয়ে উঠেছে বাঘের এক বিশাল অভয়ারন্য। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যতো বাঘ আছে তার প্রায় ৭৫% বাঘ রয়েছে ভারতে। এদের সংখ্যা আনুমানিক তিন হাজারের কাছাকাছি হবে যার মধ্যে বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা প্রায় ২,০০০ এর আশে পাশে হবে।

বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়ঃ

বেঙ্গল টাইগার বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে পাওয়া যায়। যদিও একসময় বাংলাদেশের মধুপুর, গাজীপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বেঙ্গল টাইগারের দেখা পাওয়া যেতো বর্তমান এইসব অঞ্চলে কোন বাঘের সন্ধান পাওয়া যায় না। সেই হিসেবে বাংলাদেশের সুন্দরবনেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাস্থল।

সুন্দরবনের প্রায় ,৭৭০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে রয়েল  বেঙ্গল টাইগারদের বাস। ২০০৪ সালের এক জরিপে সুন্দরবনে প্রায় ৪০০-৪২০টি বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। 

২০১৫ সালে পুনরায় জরিপ করা হলে দেখা যায় সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। তদপ্রেক্ষিতে সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সরকার নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যারফলে সর্বশেষ জরিপে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১১৪টিতে। অর্থাৎ সর্বশেষ জরিপ অনুযায়অ বাংলাদেশে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১১৪টি। 

বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে রক্ষা করার জন্য ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সংরক্ষন  গড়ে তোলার পাশাপাশি এইসব অঞ্চলে চিত্রা হরিনের আবাসস্থল গড়ে তুলেছে।এছাড়াও সম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক কঠোর ভাবে বনদস্যু ও চোরাকারবারী দমন এবং সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামের মানুষকে সচেতন করায় সুন্দরবন অংশে বাঘের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে বলে ধারনা করা হয়।

বাংলাদেশ বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই ১৭ বছর সময়ে স্বাভাবিক বয়স জনিত কারনে মারা গেছে ১০টি, বনের আশেপাশের জেলে ও মৌয়ালিরা পিটিয়ে মেরেছে ১৪টি, প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ০১টি এবং চোরাকারবারীরা হত্যা করেছে ২৫টি। অর্থ্যাৎ ১৭ বছরে ৫০টি বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবন হতে মারা গেছে।  

নেপালের যেসব অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়ঃ

নেপালের নিম্নভূমির বনাঞ্চলে ,৫৪৩ বর্গ কিমি এলাকাজুড়ে প্রায় ১২৫টির মতো রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। নেপালে বেঙ্গল টাইগারদের জন্য নির্ধারিত তিনটি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। এগুলো হলো চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্কপারসা ন্যাশনাল পার্ক, বারদিয়া ন্যাশনাল পার্ক এবং বন্দী অবস্থায়  শুক্লাফাঁটা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগারে বেঙ্গল টাইগারের দেখা যায়।

ভুটানের যেসব অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়ঃ

ভুটানে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে প্রায় ২০০মিটার উচ্চতায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাস করে। ভুটানে আনুমানিক প্রায় ৭০-৮০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। ভুটানের দক্ষিনে হিমালয় পাহাড়ের উপক্রান্তীয় বনাঞ্চলে এবং দক্ষিনের নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চলের মো নদী এবং কুলং নদীর মাঝামাঝি যায়গায় বেঙ্গল টাইগারের দেখা যায়।

এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিড়িয়াখানায় বন্দী অবস্থায় আরো কিছু রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের  বৈশিষ্টঃ

বেঙ্গল টাইগার তার কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারনে অন্য সবার থেকে আলাদা। বেঙ্গল বাঘের ১১টি অনন্য বৈশিষ্ট্য দেওয়া হলো যেগুলো হয়তো আপনার অজানা।

০১. বেঙ্গল টাইগার একাকী থাকতে পছন্দ করেঃ

বেঙ্গল টাইগার তার নিজের এলাকায় একাকী থাকতেই পছন্দ করে। শুধুমাত্র মিলনের সময় স্ত্রী পুরষ বাঘ একত্রিত হয়। এছাড়া এদের মাঝে সামাজিক পারিরিক বন্ধন থাকে না। অনেক সময় তিন চারটি বাঘকে একসাথে দেখা গেলেও বাস্তবে এগুলো মা বাঘের তরুন সন্তান যারাও কয়দিন পরে আলাদা হয়ে যাবে। সাধারনত বাঘের বাচ্চা দুই বছর পর্যন্ত মায়েল সাথে থাকে এরপর তারা আলাদা হয়ে যায়।

০২. বেঙ্গল টাইগার নিশাচর প্রানীঃ

রয়েল বেঙ্গর টাইগার নিশাচর প্রানী এরা রাতে চলাফেরা করে এবং দিনের বেলা বেশীরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে বা অলস ভাবে সময় কাটায়। খাবারের সন্ধানে বাঘ এক রাতে প্রায় ২০ মাইল এলাকা পর্যন্ত হাঁটতে পারে।

০৩. বেঙ্গল টাইগার বনের সবছেয়ে শক্তিশালী প্রানীঃ

বিড়াল প্রজাতির প্রানীদের মধ্যে বেঙ্গল টাইগার সবছেয়ে বেশী শক্তিশালী। এরা এদের ওজনের ছেয়েও বড় প্রানীকে শিকার করতে পারে এবং শিকার করার পর তাকে টেনেও নিয়ে যেতে পারে। আবার বাঘ শিকারকে তাড়া করে প্রায় একমাইল পর্যন্ত যেতে পারে।

০৪. বেঙ্গল টাইগার দক্ষ শিকারীঃ

বাঘ অনেক শক্তিশালী প্রানী। তাই শিকার ধরার ক্ষেত্রে এদের লক্ষ বস্তু খুব কম সমই ব্যার্থ হয়। শিকার ধরার পর এরা প্রথমে যে ঝাঁকুনি দেয় তাতে শিকার প্রানীটির মেরুদন্ডের কর্ড ভেঙ্গে যায় কিংবা গলায় কামড় দিয়ে ধরে যা থেকে শিকার প্রানীটি আর ছাড়া পায় না।খাবারের জন্য এরা বড় প্রানী হলে সপ্তাহে এক বা দুইবার শিকার করে ছোট আকারের প্রানী হলে প্রতিদিনই শিকার করে।

০৫. বেঙ্গল টাইগারদের নিজস্ব ভৌগলিক এলাকা আছেঃ

বন্য পরিবেশে বেঙ্গল বাঘদের নিজস্ব একটা ভৌগলিক এলাকা আছে। এই এলাকাটা খাদ্য প্রাপ্ততার উপর নির্ভর করে আকারে ছোট বড় হয়। একটি বাঘ খাবারের উদ্দেশ্যে এক রাতে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা ভ্রমন করতে পারে।

০৬. স্ত্রী বাঘিনী নিজে বাসা পছন্দ করেঃ

স্ত্রী বাঘিনী সবসময় নিজের পছন্দ মতো বাসা নির্বাচন করে। কারন স্ত্রী বাঘ সন্তানের নিরাপত্তার জন্য একটি সুন্দর নিরাপদ বাসা খোজে। বেশীরভাগ সময় তাদের বাসা হয় নদীর পাড়ে কিংবা জোয়ারের সময় যে পর্যন্ত পানি উঠে তার আসে পাশে। এর কারন হচ্ছে  পানির কাছাকাছি থাকলে গরমে বাচ্চাদের অসুবিধা না হয়।

০৭. বেঙ্গল টাইগার গাছে উঠতে পারে

বড় আকারের বিড়াল প্রজাতিগুলো মধ্যে Leopard তুখোড় গাছ আরোহী সেই হিসেব বেঙ্গল টাইগার তেমন গাছে উঠতে পারে না। তবে বিড়ালের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে এরাও অল্প বিস্তার গাছে উঠতে পারে। শিকার ধরার জন্য কিংবা মানুষের আক্রমনে এরা অনেক সময় এরা গাছে উঠে যদিও Leopard এর  মতো এরা অতোটা পরিপক্ক না।

০৮. বেঙ্গল টাইগার দারুন সাঁতারুঃ

ম্যানগ্রোভ বনের বৈশিষ্ট হচ্চে জোয়ারের সময় এইসব বনে পানি উঠে। যেহেতু ম্যানগ্রোভে বনে বেঙ্গল বাঘ থাকে সেহেতু পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এরা পানিতে সাতার কাটার বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। এরা পানিতে দ্রুত সাতার কাটতে পারে এবং পানি থেকেও শিকার করতে পারে। পানিতে শিকার করার সময় এদের মুখ থেকে শিকার ছুটে পড়ে না। 

সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার
সুন্দরবনের নদীর পানিতে রয়েল বেঙ্গল টাইগার



০৯. বেঙ্গল টাইগারের স্বতন্ত্র ডোরাকাটা দাগঃ

বেঙ্গল টাইগার স্ট্রাইপেট প্রানী যাদের শরীরে ডোরাকাটা দাগ রয়েছে। এই ডোরাকাটা দাগগুলো তাদের বড় ঘাসের মধ্যে আড়াল করতে সাহায্য করে যার ফলে এরা সহজেই শিকারের একেবারে কাছে চলে আসতে পারে। এছাড়া প্রতিটা বেঙ্গল টাইগারের গায়ের ডোরাকাটা দাগ স্বতন্ত্র। একটির সাথে অন্যটি কোনদিন মিলে না। অনেকটা মানুষের আঙ্গুলের চাপের মতো।

১০. বাঘের পশম ঝরে যায়ঃ

জন্মের পরে সদ্যজাত বাঘের বাচ্ছাগুলোর গায়ে এক ধরনের পরু পশমের আবরণ থাকে তা তিন থেকে পাঁচ মাস বয়সে এসে সম্পূর্ন ঝরে যায় এবং নতুন রূপে নতুন পশমে আবৃত হয়ে যায়।

১১. মা বাঘ বাচ্চা বাঘের মল খায়ঃ

জন্মের পর মা বাঘ তার বাচ্চাদের জিব দিয়ে অনবরত চাঁটতে থাকে যাতে করে তাদের রক্ত প্রবাহ ঠিক থাকে এবং মল ত্যাগ করতে উদ্দীপ্ত হয়। মা বাঘ অনেক সময় বাচ্চা বাঘদের মল খেয়ে ফেলে যাতে করে শত্রু প্রানীরা বাচ্চাদের মলের গন্ধে বাচ্চাদের কাছে চলে আসতে পারে। 

বাঘ সিংহের মিলনে কি হয়ঃ

একটি স্ত্রী বাঘ এবং একটি পুরুষ সিংহের মাঝে ক্রসব্রিডে জন্ম নেওয়া বাঘকে লাইগার বলে। এরা আকারে এদের পিতামাতার চেয়ে অনেক বড় হয়। একটি পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ লাইগার ১৬০০ পাউন্ড পর্যন্ত ওজন করতে পারে যা অন্য সব বাঘের ছেয়েও আকারেবৃহৎ।

আবার  বেঙ্গল টাইগার এবং সাইবেরিয়ান টাইগারের ক্রসব্রীড হয় যে বাঘের জন্ম হয় প্রাপ্ত বয়স্কে এসে তারা তাদের পিতামাতার চেয়েও আকারে বড় হয়।

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাদ্যাভ্যাসঃ

রয়েল বেঙ্গল টাইগার মাংশাসী প্রানী। তাই এরা মাংস ব্যাতীত কিছুই খায় না। তবে খাবারের অভাবে এরা মাঝে মাঝে পাখি কুমিরের  ডিমও খেয়ে থাকে। বেঙ্গল টাইগারের খাবারের মূল উপাদান মাংস এবং প্রাপ্ত বয়স্ক পুরষ বেঙ্গল টাইগারের প্রতিদিন প্রায় ২০কেজির মতো মাংসের প্রয়োজন হয়। অপরদিকে স্ত্রী টাইগারদের প্রতিদিন প্রায় -৮কেজি মাংসের প্রয়োজন হয়। তবে বাচ্ছা প্রসবের পর স্ত্রী বাঘের খাবারের পরিমান স্বাভাবিকের ছেয়ে ৫০% বেশী হয়ে যায়। বেঙ্গল টাইগার একবারে ৪০ কেজি পর্যন্ত মাংস খেতে পারে। আর এই চাহিদা মিটানোর জন্যে এরা বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রানী শিকার করে তবে শিকারের ক্ষেত্রে এদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের তৃনভোজী প্রানীরা।

বেঙ্গল টাইগারের খাবারের তালিকায় বড় আকারের প্রানীদের মধ্যে রয়েছে বনগরু (ভারতীয় বাইসন), সম্বর হরিণ, টাকিন (এক ধরনের বড় আকারের ছাগল), হিমালয়ী সেরো (এক ধরনের বনছাগল), জলহস্তী, নীলগাই, বন্যমহিষ, টাপির, হাতি, গন্ডার ইত্যাদি। তবে এই ধরনের প্রানীগুলোর মাঝে বনগরু সাম্বার বাঘের সবছেয়ে প্রিয় খাবার। এই শিকারগুলো সাধারনত আত্নরক্ষা করতে অতোটা পারদর্শী না বলে বাঘ সহজেই এদের কাবু করতে পারে। তবে বাঘ বেশীর ভাগ সময় আকারে বড় এবং শক্তিশালী এমন ধরনের প্রানীকে শিকার করা থেকে বিরত থাকে। কারন শিকার করার পর এদের টেনে নিয়ে যাওয়া বাঘের পক্ষে কষ্টকর হয়ে যায়। তবে সুযোগ ফেলে এরা বড় আকারের তৃনভোজী প্রানীদের বাছুরকে শিকার করে এবং খাদ্য সংকট থাকলে প্রাপ্ত বয়স্কদেরও শিকার করে। তবে বাঘ সাধারনত ভারতীয় গন্ডার এবং হাতিকে আক্রমন করে না যদিও এদের উপর বাঘের আক্রমনের রেকর্ড আছে। 

২০০৭ সালে ভারতের Kaziranga National Park বাঘ প্রায় ২০টি গন্ডারকে হত্যা করেছে। এছাড়া ২০১১ সাল এবং ২০১৪ সালে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দ্বারা প্রাপ্ত বয়স্ক দুটি হাতি হত্যার রেকর্ড রয়েছে।

বেঙ্গল টাইগারের সবছেয়ে পছন্দের প্রিয় খাবারের তালিকায় রয়েছে  মাঝারি আকারের তৃনভোজী প্রাণীগুলো। এদের মধ্যে রয়েছে প্যারা হরিন, চিতল হরিন, ছাগল, গরুর বাছুর, বন্য শূকর, মহিষের বাছুর, ল্যাঙ্গুর, নীলগাই ইত্যাদি। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক বেঙ্গল টাইগার বছরে প্রায় ৫০টির মতো হরিন শিকার করে থাকে এবং সপ্তাহে প্রায় একটি করে হরিন শিকার করে। কোন বাঘ যদি সপ্তাহে একটি করেও হরিন শিকার করতে পারে তাহলে সেই বাঘের খাদ্যঘাটতি হয় না। একটি বাঘ বছরে প্রায় ৩০০০ কেজি শিকার করে থাকে।

এছাড়াও খাদ্য সংকটে বেঙ্গল টাইগার কিছু কিছু ছোট আকারের প্রানীও শিকার করে থাকে। যেমন- ময়ূর, রেসাস বানর, খরগোশ, কুমিরের ডিম, বাজপাখি, সজারু ইত্যাদি। তবে সচারচর বাঘ এই ধরনের প্রানীদের শিকার করে না। কারন আকারে ছোট হওয়ায় এইগুলো বাঘের খাবারের চাহিদার খুব বেশী পূরণ করতে পারে না।

বেঙ্গল টাইগার সচারচর অন্যান্য শিকারী প্রানী বা মাংসাশী প্রানীদের শিকার করে না, তবে আত্মরক্ষা কিংবা খাবারের সংকটে এরা শিকারী প্রানীদেরও শিকার করে এদের মাংস খায়। এই তালিকায় রয়েছে- এশিয়াটিক সিংহ, হাতির বাচ্চা, গন্ডারের বাছুর, ভারতীয় নেকড়ে, এশিয়ান কালো ভালুক, স্লথ ভালুক, বন্য কুকুর, লিওপার্ড, শেয়াল, মাছ, কুমির ইত্যাদি। যদিও এইগুলো বাঘের খাবারের অংশ না। বাংলাদেশের সুন্দর বনের বাঘের পেটে একবার একটি কিং কোবরা এবং একটি ভারতীয় কোবরা পাওয়া গেছে। সেই হিসেবে বাঘ সাপও খায়।

বেঙ্গল টাইগারদের শিকার করার পদ্ধতিঃ

বিড়াল জাতীয় প্রানীরা শিকার খোজার জন্য তাদের ঘ্রান শক্তিকে কাজে লাগায় কিন্তু বেঙ্গল টাইগার এইক্ষেত্রে  একটু আলাদা। এরা শিকার খোজার জন্য এদের দৃষ্টি শক্তি এবং শ্রবণশক্তিকে কাজে লাগায়। শিকার দেখলেই এরা শিকারের পিছনে দৌড় দেয় না। বাঘ তার সময়ের বেশীরভাগই ব্যয় করে শিকার খোজার কাজে। তবে এরা রাত্রী বেলা শিকার করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। পছন্দের শিকার দেখলে এরা শিকারের চোখের আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে যতোটুকু সম্ভব শিকারের একেবারে কাছে চলে আসে। যখনি এরা শিকারকে নিজের সম্পূর্ন আয়ত্বে আনতে পারে তখনি এরা শিকারের উপর দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সচারচর বাঘ শিকারের পিছন থেকে কিংবা পাশ থেকে আক্রমন করে এবং সকল শক্তি দিয়ে শিকারের ঘাড়ের প্রধান রক্তনালীতে কিংবা গলায় কামড় দিয়ে শিকারকে মাটিতে শুয়ে ফেলে। যতোক্ষন শিকার মারা না যায় ততোক্ষন এরা শিকারের গলা হতে কামড় সরায় না। এরপর শিকার করা প্রানীকে টেনে পছন্দের নিরিবিলী যায়গায় নিয়ে যায় এবং লম্বা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে খায়।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার কি মানুষ খায়?

প্রায় সময় পত্রিকার পাতায় দেখা যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আক্রমনে মৌয়ালিদের জীবননাশ হতে। এতে হয়তো আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে বেঙ্গল টাইগার কি মানুষ খায়?

বাস্তবতা হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল  টাইগারের খাবার তালিকায় মানুষ নেই। তারপরেও মাঝে মাঝে বাঘ মানুষকে আক্রমন করে হত্যা করে এবং মানুষের মাংস খায়। তাই এদেরকে অনেকে নরখাদকও বলে। বাস্তবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মানুষের উপর আক্রমনের ঘটনা প্রতি হাজারে মাত্র দশটি। মানুষের উপর আক্রমনের এই দশটির মধ্যে ০৬ টি আক্রমন ঘটে অসুস্থ বা বৃদ্ধ বাঘ দ্বারা যারা শিকার করতে পারে না তাই খাদ্য সংকটে মানুষের উপস্থিতি পেলে এরা মানুষের উপর আক্রমন করে বসে। বাকি চার ভাগ হচ্ছে অনিচ্ছাকৃত আক্রমন। যখন মানুষ বাঘের বসতিতে প্রবেশ করে তখন বাঘ তার এলাকায় মানুষের উপস্থিতি নিরাপদ মনে করে না আর তাই নিজেদের এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার মানুষের উপর আক্রমন করে। এছাড়াও মাঝে মাঝে বন্য পরিবেশে খাবারের সংকট দেখা দিলে বেঙ্গল টাইগার বনের নিকটবর্তী লোকালয়ে চলে এসে গৃহপালিত গরু কিংবা ছাগলের উপর আক্রমন করে। এইসময় মানুষ কর্তৃক বাঁধাপ্রাপ্ত হলে এরা মানুষের উপর আক্রমন করে বসে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রজননঃ

বাঘের কোন নির্দিষ্ট প্রজনন ঋতু নেই। পুরষ বাঘ সাধারনত - বছর বয়সে এবং স্ত্রী বাঘ - বছর বয়সে প্রজননের জন্য উপযোগী হয়। স্ত্রী রয়েল বেঙ্গল টাইগার - সপ্তাহ পর পর হিট সাইকেলে আসে। হিট সাইকেলের সময় থাকে -৬দিন পর্যন্ত। বাঘের গর্ভকালীন সময় প্রায় ৯৩-১১২ দিন। বাচ্চা প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে স্ত্রী বাঘ একটি নিরাপদ বাসাখোজার জন্য বেশী সময় ব্যায় করে। নিরাপদ কোন যায়গা ফেলে সেইখানে স্ত্রী বাঘ বাচ্চা প্রসব করে। স্ত্রী বাঘ একসাথে দুই থেকে সাতটি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করতে পারে। তবে গড়ে তিনটি করে প্রসব করে। জন্মের পর বাঘের বাচ্চাদের ওজন হয় সাধারনত এক থেকে দেড় কেজী পর্যন্ত।  বাঘের বাচ্চা অন্ধ হয়ে জন্মায় এবং জন্মের প্রায় সাত থেকে বার দিন পরে এদের চোখ খোলে। তবে পরিপূর্ন ভাবে দেখতে আরো দুই এক সপ্তাহ সময় লাগে।

জন্মের প্রায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে বাচ্চা বাঘদের দুধ দাঁত উঠতে শুরু করে এবং -১০ সপ্তাহ বয়সের পর থেকে দুধ দাঁত স্থায়ী দাঁত দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। বাচ্চা জন্মের পর স্ত্রী বাঘ তার দিনের প্রায় ৭০% সময় ব্যায় করে সদ্যজাত বাচ্চাদের যত্ন এবং দুধ খাওয়ানোর পিছনে। বাচ্চাগুলো বড় হওয়ার সাথে সাথে দুধ খাওয়ার পরিমানও কমতে শুরু করে। দুই মাস বয়স পর থেকেই বাচ্চা বাঘগুলো শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে। তবে প্রয় ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ খায়। দুই তিন মাস বয়স পর থেকেই বাঘের বাচ্চাগুলো শিকার ধরার কাজে মা বাঘকে অনুসরন করে। বাচ্চা বাঘের বয়স যখন - মাস তখন তারা শিকার ধরার কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ শুরু করে। প্রায় দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চা বাঘগুলো মায়ের সাথে থাকে। এরপর এরা স্বাধীন ভাবে থাকার জন্য আলাদা একটি অঞ্চল নির্বাচন করে এবং মায়ের এলাকা ছেড়ে চলে যায়। বাচ্চা জন্ম থেকে শুরু করে ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত এই দুই থেকে আড়াই বছর সময় স্ত্রী বাঘ হিট সাইকেলে আসে না। বাচ্চাগুলো চলে যাওয়ার পরে স্ত্রী বাঘ পুনরায় হিট সাইকেলে আসে।

মন্তব্যঃ

প্রকৃতির এই অপরূপ সুন্দর একটি প্রানী আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারন হচ্ছে অবৈধ চোরাচালানীরা বাঘের চাড়মা ও মাংস চীনে রপ্তানি করে। চীনে বাঘের মাংস ও চাড়মার চাহিদা অনেক বেশী থাকায় চোরাকারবারীরা নির্বিচারে বাঘ হত্যা করে এদের সংকটে ফেলে দিয়েছে। 

এছাড়াও অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে বন জঙ্গল কেটে উজাড় করা হচ্ছে যাতে বাঘের স্বাভাবিক আশ্রয়স্থল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাঘ হারিয়ে যাওয়া মানে একটি অঞ্চলের সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া। তাই প্রকৃতির এই অপরূপ সুন্দর বাঘকে রক্ষা করা এখন সময়ে দাবী। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url