বন্যপ্রানী ও বন্যজীবন কি? মানব জীবনে বন্যপ্রানীর গুরুত্ব
সাইবেরিয়ান বাঘ |
বন্যজীবনঃ
আমরা যখন বন্যজীবন শব্দটি ব্যাখ্যা করতে যাই, আমরা এর দুটি অংশ খুঁজে পাই।
০১. বন্য এবং
০২. জীবন
বন্য বলতে আমরা সাধারনত বুজি যারা গৃহপালিত নয় এবং জীবন মানে যাদের প্রান/জীবন আছে।
তাই বন্যপ্রাণীর সরল অর্থ হল “বনে বেড়ে ওঠা সমস্ত জীবন”।
আবার জীবনকে সংঙ্গায়িত করতে গেলে আমরা দুই ধরনের প্রানের দেখা পাই-
০১. যারা নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না বরং খাদ্যের জন্য পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সহজ অর্থে সকল ধরনের প্রাণী।
০২. সেই সব প্রান যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে পারে অর্থাৎ সব ধরনের উদ্ভিদ।
বিস্তারিতভাবে, বন্যজীবন বলতে সেই সমস্ত জীবন্ত জিনিস যা প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বাধীনভাবে বৃদ্ধি পায়। এর মানে হল, পরিবেশের সেই সব জীব উপাদান যা প্রাকৃতিক পরিবেশে বৃদ্ধি পায় এবং বিকশিত হয়, যেখানে মানুষের হস্তক্ষেপ নেই তাকে বন্যজীবন বলা হয়।
পূর্বে বিভিন্ন শৈবাল, ছত্রাক, বন্য সবজী বা ফলকে বন্যজীবনের আওতামুক্ত রাখা হলেও বর্তমানে মানুষের চাষাবাদ ব্যাতীত যেসব উদ্ভিদ, শৈবাল কিংবা ছত্রাক আছে তাদেরও বন্যজীবনের আওতায় রাখা হয়েছে।
কেমব্রিজ ডিকশনারি অনুযায়ী বন্যজীবনের সংজ্ঞা-
"প্রাণী এবং উদ্ভিদ যা মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বাধীনভাবে বৃদ্ধি পায়"
এখানে প্রানী বলতে , মানুষ, গৃহপালিত পশু এবং কীটপতঙ্গ ব্যাতীত অন্যসব প্রানী যারা চলাফেরা করতে পারে।
উদ্ভিদ মানে, সেই সব জীবন্ত জিনিস যারা জলে কিংবা স্থলে বৃদ্ধি পায় এবং যাদের কান্ড, পাতা, শিকড়, ফুল এবং বীজ থাকে। [রেফারেন্স -১]
মেরিয়াম ওয়েবস্টার এর সংজ্ঞা অনুযায়ী-
"জীবন্ত বস্তু এবং বিশেষ করে স্তন্যপায়ী, পাখি এবং মাছ যা মানুষের নিয়ন্ত্রনাধীন নয় বা গৃহপালিত নয়" [রেফারেন্স -২]
বন্যপ্রানীঃ
বন্যপ্রানী বলতে সেই সব প্রানী যারা মানুষের নিয়ন্ত্রনাধীন না বরং স্বাধীনভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠে এবং টিকে থাকতে পারে তারাই বন্যপ্রানী।
যেহেতু বন্যপ্রানী বলা হয়েছে তাই এইখানে শুধুমাত্র প্রানীদের রাখা হয়েছে কোন উদ্ভিদকে রাখা হয় নাই। আবার প্রানী জগতের ১০টি পর্বের মধ্যে শুধুমাত্র কর্ডাটা পর্বের প্রানীদেরই বন্যপ্রানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কর্ডাটা পর্বের প্রানীরাই একমাত্র মেরুদন্ডী প্রানী এবং এরাই সবছেয়ে উন্নত তাই মানুষ এবং পোষা প্রানী ব্যতীত কর্ডাটা পর্বের সেই সব প্রানী যারা মানুষের নিয়ন্ত্রনাধীন না বরং বন্য পরিবেশে স্বাধীন ভাবে টিকে থাকতে পারে তারাই বন্যপ্রানী। যেমন- বাঘ, সিংহ, বানর ইত্যাদি।
বন্যপ্রানী হতে গেলে বনেই থাকতে হবে এমন কোন ব্যাপার না। কারন আমাদের আশ পাশে অনেক প্রানী আছে যারা গৃহপালিত না তারাও বন্যপ্রানী। যেমন- বিভিন্ন ধরনের পাখি, সাপ, কচ্ছপ ইত্যাদি।
বন্যপ্রানীর গুরুত্বঃ
বিশদ অর্থে বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকা সব উদ্ভিদ এবং প্রাণী প্রজাতি। মানুষ সহ সমস্ত জীব, বেঁচে থাকার জন্য একে অন্যের উপর নির্ভর করে। টিকে থাকার জন্য মানুষ যেমন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বন্যপ্রানীর উপর নির্ভরশীল তেমনি বন্যপ্রানীরাও টিকে থাকার জন্য মানুষের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তার প্রয়োজনে বন্যপ্রানীকে ব্যবহার করে আর বন্যপ্রানী মানুষের কাছে আশা করে একটি টিকসই ব্যবস্থাপনা যা বন্যপ্রানীকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।
কিন্তু মানুষ তাদের প্রয়োজনে বন্যপ্রানীকে অহরহ ব্যবহার করছে অথচ বন্যপ্রানীদের টিকে থাকার দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। তাই প্রতিনিয়তই বন্যপ্রানীর প্রজাতি বিলুপ্তি ঘটছে। বন্যপ্রানী বিলুপ্তির মূল কারন হচ্ছে আমরা বন্যপ্রানীর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছি না। অথচ আমাদের জীবনের প্রতিটি মূহর্তে বন্যপ্রানীর অবদান রয়েছে। মানুষ তখনি বন্যপ্রানী সংরক্ষনে এগিয়ে আসবে যখন বন্যপ্রানীর গুরুত্ব সর্ম্পকে জানতে পারবে।
বন্যপ্রানীর গুরুত্বকে বর্ণনার সুবিধার জন্য আমরা মূল চারটি ভাগে ভাগ করেছি।
০১. বন্যপ্রানীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব।
০২. চিকিৎসা বিজ্ঞানে বন্যপ্রানীর গুরুত্ব।
০৩. নান্দনিক ও বিনোদনমূলক গুরুত্ব।
০৪. বন্যপ্রানীর বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব।
নিছে বন্যপ্রানীর এই গুরুত্বসমূহের বিশদ বর্ণনা দেওয়া হলো।
০১. বন্যপ্রানীর অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ
অর্থনৈতিক গুরুত্বের পরিধি বিবেচনা করলে মানব জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বন্যপ্রানীর গুরুত্ব রয়েছে। নিছে কয়েকটি পয়েন্টে বন্যপ্রানীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরা হলো।
ক) খাদ্য হিসেবে বন্যপ্রানীঃ
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ তার মৌলিক প্রয়োজন খাদ্যের জন্য সরাসরি বন্যপ্রানীর উপর নির্ভরশীল ছিলো। কৃষিকাজ ও পশুপালন শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত মানুষের খাদ্যের একমাত্র উৎস ছিলো বন্যপ্রানী। কৃষিকাজ ও পশু পালনের সময় থেকে খাদ্যের জন্য বন্যপ্রানীর উপর সরাসরি নির্ভরশীলতা কমলেও তা শেষ হয়ে যায়নি। বিশেষ করে কিছু কিছু উপজাতী যারা এখনো বন্যপরিবেশে বা এর আশে পাশে বাস করে তারা খাদ্যের জন্য এখনো সরাসরি বন্যপ্রানীর উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও মানুষ এখনো খাবারের উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়তই বন্যপ্রানী শিকার করে আসছে। পাকিস্থানের বালোচিস্তান প্রদেশে হুবারা বাস্টার্ড নামে একধরনের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। প্রচলিত আছে যে, এই পাখির মাংস যৌনশক্তি বাড়াতে সহায়ক। যার ফলে প্রতিবছর আরবের শেখরা এইখানে পাড়ি জমায় শুধুমাত্র হুবারা বাস্টার্ড পাখি শিকার করতে। যার ফলে এই পাখিটি এখন বিলুপ্তির পথে।
খ) বস্ত্র শিল্পে বন্যপ্রানীঃ
খাদ্যের পরে মানুষের মূল মৌলিক চাহিদা হচ্ছে বস্ত্র। আর এই বস্ত্র শিল্পের সম্পূর্ন কাঁচামাল এখনো বন্যপ্রানীর উপর নির্ভরশীল।বস্ত্র শিল্পের মূল উপকরন যেমন- পশম, চাড়মা এবং সুতার জন্য এখনো বন্যপ্রানীর উপর নির্ভর করতে হয়। যদিও মানুষ গৃহপালিত পশুর চাড়মা ও পশম ব্যবহার করা শুরু করেছে তারপরেও কিছু কিছু অতিমূল্যবান কাঁচামাল আসে সরাসরি বন্যপ্রানী হতে। যেমন বাঘ, হরিন এবং কুমিরের চাড়মার জন্য প্রতিনিয়ত এগুলোকে শিকার করা হচেছ। এছাড়াও পালকের জন্য এখনো বন্য পাখির উপর সর্ম্পূন নির্ভর করতে হচ্ছে।
গ) আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বন্যপ্রানীঃ
বস্ত্র শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে বস্ত্র শিল্পের বিকাশের জন্য গড়ে উঠেছে নিত্য নতুন অবকাঠামো। আর্থিক সক্ষমতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানুষের জীবনযাত্রায়ও ভূমিকা রাখে। যার মাধ্যমে আমরা বিশ্বের মানচিত্রে কোন একটা রাষ্ট্রের অবস্থান র্নিণয় করে থাকি।
ঘ) রপ্তানি আয়ঃ
কোন একটি দেশের অর্থনীতের মূল হচ্ছে রপতানী আয়। বন্যপ্রানী এই রপ্তানী আয়ের বিশাল একটি অংশ ধরে রেখেছে। যদি আমরা বিশ্ব বাণিজ্যের চিত্র দেখি, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে শুধুমাত্র ২০১৮ সালে ৮৪.৪ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক মাছ রপ্তানির জন্য ধরা হয়েছিল। যা যেকোন দেশের জন্য অনেক বড় সম্পদ। শুধু মাছ নয়, সব ধরনের বন্যপ্রাণীও রপ্তানি করা হয়। বিশেষ করে মেরুদণ্ডী প্রাণী, বড় গাছ, গুল্ম ইত্যাদি। বর্তমানে প্রায় ৫,৫০০ প্রজাতির পাখি, স্তন্যপায়ী, উভচর এবং সরীসৃপ বৈধভাবে সারা বিশ্বে রপ্তানি করার অনুমতি রয়েছে। এর বাজার মূল্য ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এছাড়া চোরাকারবারিরা গোপনে অনেক বন্যপ্রানী প্রচার করে প্রচুর টাকা উপার্যন করে থাকে যার কোন সঠিক হিসেব নেই।
ঙ) কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বন্যপ্রানীঃ
বন্যপ্রানী থেকে যখন রপ্তানি আয় সম্ভব তখন অবধারিত ভাবে এর মাধ্যমে অজস্র লোকের কর্মস্থানেরও সুযোগ হয়। যেমন বাংলাদেশের উপকূলের বেশীরভাগ জনগনই সরাসরি মাছ শিকারের উপর নির্ভরশীল। মৎস সম্পদ তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়াও বন্যপ্রানী সংরক্ষন ও রক্ষনাবেক্ষনের সাথে অনেক মানুষ জড়িত।
০২. চিকিৎসা বিজ্ঞানে বন্যপ্রানীর গুরুত্বঃ
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চিকিৎসা কিংবা ঔষদের জন্য বন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল ছিলো যা বর্তমানে এসেও অব্যাহত আছে। উদ্ভিদ এবং উদ্ভিদের রস থেকে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৮০% মানুষই ঔষদ পেয়ে থাকে। ভেষজ উদ্ভিদ কিংবা অন্যান্য উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ঔষদের বাজার মূল্য বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
Madagascar যা আমরা নয়ন তারা ফুল গাছ হিসেবে জানি তা থেকে ক্যান্সার প্রতিরোধী ঔষদ তৈরী করা হয়। Madagascar গাছ থেকে প্রাপ্ত ক্যান্সার প্রতিরোধী ঔষদ শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে ৩০ হাজার লোকের জীবন রক্ষা করে।
এই গাছের পাতা থেকে নিষ্কাশনকৃত রস হতে এক ধরনের ঔষদ তৈরী করা হয় যা Lymphocytic leukemia and Hodgkin’s রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। আর এই ঔষদের বিক্রয় মূল্য বার্ষিক ১৬০ মিলিয়ন ডলার।
সাপের কামড়ের ভ্যাক্সিন তৈরী করার জন্য বন্যপ্রানীর উপর নির্ভর করতে হয়। আবার হার্টের ঔষুদের কাঁচামাল পিট ভাইপার সাপের বিষ। এছাড়াও বন্যপ্রানীর চাড়মা, নির্যাস হতে সরাসরি কিংবা মডিফাই করে অনেক রকম ঔষদ তৈরী হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত সকল ঔষদ পরীক্ষা করার জন্য প্রাথমিক ভাবে তা বন্যপ্রানীর উপর প্রয়োগ করা হয়। যাকে ক্লিনিকাল ট্রায়ালও বলা হয়। এই ক্লিনিকাল ট্রায়াল বেশীরভাগ সময়ই বানর, খরগোস, ইঁদুরের উপর প্রয়োগ করা হয়।
বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বেবুনের ফুসফুস মানুষের ফুসফুসে ট্রান্সফার করার চেষ্টা করছে। ব্যাঙের চামড়ায় পাওয়া অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রোটিন দ্বারা ডায়াবেটিকস এর ঔষদ তৈরী হয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে জোঁকের ব্যবহার সেই আদিমকাল থেকে আজও চলমান রয়েছে। Gila Monster নামক গুই সাপের বিষ থেকে ডায়াবেটিকস এর ঔষদ তৈরী করা হয়।