পেঁচা সম্পর্কে অজানা তথ্য যা আগে কখনো শুনেন নি।
পেঁচার নাম শুনে নাই এমন লোক খুজে পাওয়া দুস্কর। অন্তত গ্রাম বাংলায় যারাই থাকে তারা সবাই পেঁচা ও পেঁচার ডাকের সাথে পরিচিত। পেঁচা মূলত Strigiformes পর্বের একটি মেরুদন্ডী পাখি। যার ইংরেজী নাম Owl. সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০০ এর অধিক প্রজাতির পেঁচা দেখতে পাওয়া যায়। যদিও বাংলাদেশে মাত্র ১৭ প্রজাতির পেঁচা দেখতে পাওয়া যায়। যার মাঝে আবার দুইটি প্রজাতি পরিযায়ী। পেঁচা সম্পর্কে আমাদের সমাজে অনেক কুসংস্কার রয়েছে। আজকে আমরা পেঁচা সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য জানবো যা হয়তো আপনি আগে কখনো শুনেন নি।
লক্ষী পেঁচা (সোর্স piqsels) |
পেঁচা সম্পর্কে দশটি অজানা তথ্য
০১. সারা পৃথিবীতে প্রাপ্ত পেঁচা গুলোকে দুইটি পরিবারে ভাগ করা হয়। সাধারণ প্যাঁচা বা Strigidae এবং লক্ষ্মীপ্যাঁচা বা Tytonidae. লক্ষী পেঁচা সাধারনত গ্রাম বাংলার সর্বত্রই দেখা যায়। সেই আদিমকাল থেকেই কৃষকদের ফসলের বড় শক্র হচ্ছে ইঁদুর। ইঁদুর কৃষকের ফসল কেটে সাবাড় করে কৃষকের অনেক আর্থিক ক্ষতি করে। পেঁচার অন্যতম প্রধান খাবার হচ্ছে ইঁদুর। এক জোড়া পেঁচা বছরে প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি ইঁদুর খায়। যেহেতু ফসলের মাঠে ইঁদুরের প্রাচুর্যতা বেশী তাই পেঁচা ফসলের মাঠের আসে পাশেই থাকে এবং ইঁদুর শিকার করে কৃষকের ফসলকে রক্ষা করে। কৃষিতে এদের এই উপকারের জন্য আদিমকালের কৃষকেরা এদেরকে তাদের জন্য লক্ষী মনে করতো। যার ফলে এদের নাম লক্ষী পেঁচা হয়। প্রাচীন গ্রীকের অনেক মুদ্রায় এদের লক্ষী পেঁচার ছবি দেখতে পাওয়া যেতো।
০২. সনাতন ধর্মে পেঁচা হচ্ছে লক্ষীর বাহন। এই ধর্মীয় কুসংস্কারের অনেকেই নিজেদের ভাগ্য ভালো হবে কিংবা আর্থিক উন্নতি হবে এই আশায় পেঁচা জবাই করে এদের শরীরের বিভিন্ন অংশ তাবিজের খোলসে ভরিয়ে তা হাতে কিংবা গলায় পরে। এই কারনে ইন্ডিয়া লক্ষী পেঁচা অনেক চড়া দামে কেনা বেচা হয়। বিশেষ করে দিপাবলীর সময় এদের দাম অনেক বেড়ে যায়। কারন দিপাবলীর সময় সনাতন ধর্মের অনুসারীরা লক্ষী পূজা করে। আর যেহেতু তারা মনে করে পেঁচা লক্ষীর বাহন তাই তখন অনেকেই পেঁচা বলি দেয়। এই সময় আকার অনুযায়ী একটি লক্ষী পেঁচার দাম আট হাজার থেকে বিশ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
০৩. পেঁচা এক ধরনের স্থলজ পাখি। স্থলজ পাখিদের বৈশিষ্টি অনুযায়ী পেঁচা উড়তে পারে। কিন্তু কিছু কিছু পেঁচা সাতারও কাটতে পারে। কথাটা শুনে অবাক হয়েছেন নিশ্চই? আসলে পেঁচা সাতার কাটতে পারে না। মূল ঘটনা হচ্ছে Great Horned owl নামে বিশাল আকারের পেঁচা আছে যারা শিকারের খোজে জলাশয়ের আশে পাশের গাছে বসে থাকে। জলজ সাপ কিংবা ছোট মাছ দেখলে তা শিকার কারার জন্য পানিতে ঝাপ দেয়। ফলে এদের পালকগুলো পানিতে ভিজে যায়। আর ভেজা পালক অনেক ভারী হওয়ায় এরা এতো ওজন নিয়ে উড়তে পারে না। ফলে এরা সাতার কেটে পাড়ে আসে।
০৪. ছোট বেলায় পাঠ্য পুস্তকে পড়ে এসেছেন পেঁচা নিশাচর প্রানী। আবার রাতের বেলা পেঁচার ডাক শুনেছেন এমনকি দেখেছেনও। আবার অনেকেই দিনের বেলায় পেঁচা শিকার করতো করতো কারন এরা দিনে চোখে কম দেখতে পায় বলে। কিন্তু কিছু কিছু পেঁচা আছে যারা দিনের বেলায় বেশ ভালোভাবে দেখতে পারে। Great Gray, Northern Hawk, Northern Pygmy এরা এই দিনে চোখে দেখা শ্রেনীরে পেঁচা। মূলত এরা যেসব অঞ্চলের আবাসিক পাখি সেইসব অঞ্চলে রাতের বেলা তেমন কোন শিকার পাওয়া যায় না। যার ফলে খাদ্যের অন্বেষনে এরা দিনের আলোতেই বের হয়। আর এভাবেই বংশ পরম্পরায় এরা দিনের আলোতে দেখার বৈশিষ্ট অর্জন করেছে। খাদ্যের অভাব কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যের কারনেই তাদের এই পরিবর্তন।
Northern Hawk পেঁচা (Source wikimedea commons) |
০৫. পেঁচা তার মাথাকে ৩৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরাতে পারে। এর কারন হচ্ছে এদের গাড়ের হাঁড়ের গঠন। সচারচর মানুষ সহ অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রানীদের গাড়ের হাঁড়ে সাতটি জয়েন্ট থাকে সেখানে পেঁচার তার দ্বিগুন মানে ১৪টি জয়েন্ট আছে। যার ফলে এদের ঘাড় ৩৬০ ডিগ্রী পর্যন্ত ঘুরানো যায়। আর এই অন্যন্য বৈশিষ্টই হয়তো পেঁচাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। কারন পেঁচা রাতের শিকারী। পেঁচা গাছের ডালে একভাবে বসে থাকে এবং কিছুক্ষন পর পর কোনরূপ নড়াচড়া না করেই মাথা চারপাশে ঘুরিয়ে শিকার খোজে। এতে করে তাদের শিকার ধরতে সুবিধে হয়।
০৬. আপনার নিজ চোখে দেখা পেঁচা কতো বড় ছিলো? আপনার ধারনাকে হার মানাবে কিউবার Giant Owl বা দানব পেঁচা। এরা আকারে প্রায় সাতে তিনফুটের মতো হয়ে থাকে। উটপাখির পরে এরাই সবছেয়ে বড় আকারের পাখি। তবে দুঃখের কথা এই পেঁচাগুলো বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিউবার বনে এদের অস্থি বা কঙ্কাল পাওয়া গেছে। যা রিচার্জ করে বিজ্ঞানীরা এদের আকার সম্পর্কে ধারনা করেছেন। এতো বড় শরীর নিয়ে এই পেঁচাগুলো উড়তে পারতো কিনা তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তবে আমার মনে হয় এরা উড়তে পারতো না এতো বড় শরীর নিয়ে। যদি এরা উড়তেই পারতো তাহলে এরা বিলুপ্ত হতো না। এটা একান্তই আমার মতামত।
০৬. সকল মেরুদন্ডী প্রানীদের দেখার জন্য একজোড়া চোখ আছে। পাখিরাও এর ব্যাতিক্রম না। এখন যদি আমি বলি Northern Pygmy Owl নামক পেঁচার চারটি মানে দুই জোড়া চোখ আছে তখন কথাটা কি বিশ্বাস করবেন? অবাক হবেন না আসল ঘটনা অন্যরকম। এই পেঁচাগুলোর মাথার পিছনের পালকগুলো একটু উঠানো থাকে। যা দেখতে অবকিল চোখের মতো মনে হয়। আর এদের সত্যিকারের একজোড়া চোখ আছে যা উজ্জ্বল হদুল বর্ণের। পেছনের এই চোখ সাদৃশ পালকগুলো মূলত শিকারকে ভড়কে দেওয়ার কাজে ব্যবহার হয়।
০৭. পেঁচা কবে আমাদের এই পৃথিবীতে এসেছে তা নিয়ে নিশ্চিত করে বলা না গেলেও গবেষকদের দাবী আমাদের পৃথিবীতে মানুষের আগমনের অনেক আগেই পেঁচা এই পৃথিবীতে এসেছে। এই আগে কতো বছর আগে তাও সঠিক ভাবে জানা না গেলেও ধারনা করা হয় ডাইনোসরদের ৩৫০০ বছর আগে পেঁচার জন্ম হয়েছে আমাদের এই পৃথিবীতে। পেঁচার জীবাষ্ম গবেষনা করে গবেষকরা অনুমান করেন আজ থেকে প্রায় ছয় কোটি বছর আগে পেঁচার জন্ম হয়েছে।
Elf Owls |
০৮. কানাডা ও আমেরিকায় Elf Owls নামে এক ধরনের ছোট আকারের পেঁচা পাওয়া যায় যারা বর্তমান পৃথিবীর সবছেয়ে ছোট আকারের পেঁচার স্বিকৃতি লাভ করে আছে। এদের উচ্ছনা মাত্র ছয় ইঞ্চি এবং ওজন মাত্র ৪০ গ্রাম। আকারে একটি গলফ বলের সমান। আকারে ছোট বলে এদের অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। কারন এরা নিজেরা বাসা বানানোর ঝামেলায় না গিয়ে কাঠ ঠোকরার বাসা হতে কাঠ ঠোকরাকে বের করে নিজে সেই বাসায় থাকে।
০৯. পেঁচা কোন প্রকার শব্দ করা ছাড়াই উড়তে পারে। এদের শরীরের বিশেষ ধরনের পালক থাকে যা উড়ার সময় শব্দ নিয়ন্ত্রন করে। নিয়ন্ত্রন বলতে ডান ঝাপটানোর সময় কোন শব্দ উৎপন্ন হয় না বিশেষ ধরনের ফালকের কারনে।
১০. পেঁচা ভয়ংকর রকমের শিকারী। এরা শিকারকে ধরে প্রথমে তাদের পায়ের নখ এবং পায়ের পাতা দিয়ে চেপে ধরে হত্যা করে। এরপর শিকার যদি চোট আকারের হয় তাহলে তা সরিসরি গিলে খেয়ে ফেলে। এদের পাকস্থলি গলদকরনকৃত খাবার হতে পালক/পশম, হাঁড় ইত্যাদি হজন না করে বজ্য হিসেবে বের করে দেয়। মাংশাসী পাখিদের মধ্যে পেঁচা নিজেদের সন্তানের মাংসও খেয়ে থাকে। পরিবারে দুর্বল বাচ্ছার জন্ম হলে মা পেঁচা তাকে হত্যা করে অন্য সন্তানদের মাঝে ভাগ করে দেয়। এমনকি নিজেও খেয়ে থাকে। শুধু মাত্র নিজের প্রজাতিভূক না এরা অন্য প্রজাতির পেঁচা কিংবা তাদের ছানাকেও সুযোগ ফেলে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। Great horned পেঁচাগুলো Barred প্রজাতির পেঁচাকে আক্রমন করে এবং ধরতে পারলে খেয়ে ফেলে।