দোয়েল পাখির বিভিন্ন ধরনের ডাক ও নাচানাচি ভিডিও সহ
দোয়েল আকারে একটি ছোট পাখি কিন্তু তার মিষ্টি ডাকে সবাইকে মোহিত করে। এটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারত সহ উপমহাদেশের সবার কাছে একটি পরিচিত পাখি। দোয়েল পাখি মেরু এবং মরুভূমি অঞ্চল ছাড়া সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে দেখতে পাওয়া যায়। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই দোয়েল পাখি দেখা যায়। চারপাশে এদের অবাদ বিচরন ও উপস্থিতির কারনে এটি সবার কাছেই পরিচিত যার ফলে দোয়েল পাখিকে বাংলাদেশের জাতীয় পাখি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
দোয়েল পাখি |
এক নজরে দোয়েল পাখির পরিচিতি
ইংরেজি নাম |
Oriental Magpie Robin |
স্থানীয় নাম |
Doyel, Dowel, Doal. |
বৈজ্ঞানিক নাম |
Copsychus saularis (কপসিকাস সাউলারিস) |
ভৌগলিক এলাকা |
দোয়েল পাখি মেরু ও মরু অঞ্চল ছাড়া সর্বত্রই দেখা যায়। তবে বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ভারত, শ্রীলংকা, দক্ষিন চায়না, পূর্ব এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়া, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, বর্ণিও এবং জাবা অঞ্চলে এদের উপস্থিতি বেশী পরিমান দেখা যায়। |
ওজন এবং উচ্চতা |
লম্বায় ১৮-২১ সেন্টিমিটার এবং ওজনে ৩১-৪২ গ্রাম। |
খাবার |
পোকামাকড় এবং কেঁচো। |
বাসস্থান |
প্রজনন মৌসুমে ছোট ঝোপঝাড়ে, ছোট গাছে কিংবা গাছের গর্তে বাসা করে ডিম পাড়ে। |
প্রজনন মৌসুম |
মার্চ থেকে জুলাই |
বাচ্চার সংখ্যা |
৩-৫টি |
দোয়েল পাখির ডাক এবং গান
দোয়েল গায়ক পাখি হিসাবে পরিচিত। এরা মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এবং শহর বা গ্রামে সর্বত্র দেখা যায়। যার কারনে সবাই দোয়েল পাখির ডাকের সাথে পরিচিত।
দোয়েল পাখি টানা গান গাইতে পারে। যা আমরা দোয়েল পাখির ডাক হিসেবেই জানি এবং আমরা সবাই এই ডাকের সাথে পরিচিত। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী পাখিরা তাদের গলার স্বার পরিবর্তন করে বিভিন্ন ভাবে ডেকে উঠে। সেই ডাকের মর্মার্থ তাদের স্বজাতীয়রা ছাড়া অন্যরা বুজতে পারে না। দোয়েল পাখি সারাদিনই জোরে জোরে শিস দিয়ে তাদের উপস্থিতি সবাইকে জানান দেয়। তবে ঊষাকালে যখন খাবারের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন মনের সুখে ডাকতে থাকে আবার সন্ধ্যার আগে গৌধূলী লগ্নে তারা জোরে জোরে শিস দিতে থাকে। এছাড়া দিনের মধ্যভাগে বা যখন সূর্যের আলো তাপমাত্রা বেড়ে যায় তখন এদের ডাকাডাকির পরিমান কমে যায়। তবে প্রয়োজন হলে এইসময়ও তারা ডাকতে পারে। প্রয়োজন অনুযায়ী দোয়েল পাখির স্বর ভিন্ন হয়ে যায়। আজকের পোস্টে আমরা দোয়েল পাখির সেইসব ডাকের সাথেই পরিচিত হবো।
দোয়েল পাখির ডাকের ধরন
পাখিরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে তাদের ডাক। তাই তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ডাকের ধরনও ভিন্ন হয়ে থাকে। উদাহরন হিসেবে বলা যায় স্ত্রী দোয়েল পাখিকে আকৃষ্ট করার জন্য পুরুষ দোয়েল পাখি যে ধরনের মিষ্টি ডাক দেয় বিপদে পড়লে কিন্তু সেই একই রকম ডাক দিবে না। তাই তাদের ডাকে কখনো থাকে ভালোবাস, কখনো বা আনন্দ আবার কখনো ভয়। আর তাদের স্বজাতীয়রা সেই ডাক বুজে সেই ডাকে সাড়া দেয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতি দোয়েল পাখির ডাক বিশ্লেষন করে তাদের মাঝে কয়েক ধরনের ডাক দেখা যায়।
নিছে দোয়েল পাখির ডাকের ধরন সম্পর্কে তুলে ধরা হলো।
জীবনের প্রথম ডাক বা সূচনা ডাকঃ
জন্মের পরে দোয়েল পাখির বাচ্চারা প্রথম তিন থেকে চার দিন কোন শব্দ করে না। এই সময়ে তারা চুপ থাকে। তিন -চার দিন পর তারা প্রথমবার ডাকাডাকি শুরু করে। যা তাদের জীবনের প্রথম ডাক। এই ডাকটি একেবারে শান্ত এবং মৃদু শব্দের। এই ডাকের মাধ্যমে নবজাতক দোয়েল পাখির বাচ্চারা তাদের পিতা মাতার সাথে যোগাযোগ করে। মৃদু শব্দের এই নরম ও ডাকে, তারা তাদের পিতামাতার সাথে কথা বলে তাদের বুজানোর চেষ্টা করে কতটা ক্ষুধার্ত। জন্মের প্রথম সপ্তাহে বেশিরভাগ সময়ই বাচ্চাগুলো চুপ থাকে। যখনি মা কিংবা বাবা দোয়েল পাখি বাসার কাছে আসে তখন বাচ্চাগুলো ডাকাডাকি করে তাদের মা বাবা পাখির সাথে কথা বলে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের স্বরে পরিবর্তন আসে এবং শব্দের তীব্রতা বাড়তে থাকে।
সতর্ককরন ডাকঃ
দোয়েল পাখি যখন বিপদের আঁচ বুজতে পারে তখন ভিন্ন একধরনের ডাক দিয়ে অন্যদের সর্তক করে দেয়। বিশেষ করে বাচ্চা দোয়েল পাখিগুলো যখন বাসায় থাকে তখন বাসার আশে পাশে বিড়াল, বাজপাখি, সাপ, পেঁচা, কিংবা গন্ধগোকূল এর উপস্থিতি দেখলে কিংবা অন্যকোন ধরনের বিপদের উপস্থিতি টের ফেলে বাবা মা দোয়েল পাখিগুলো বাসার নিকট না এসে দূরে থেকে উচ্চস্বরে ডাক দিতে থাকে। তাদের এই ডাকের শব্দ শুনলে বাচ্চা গুলো বিপদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাসায় একেবারেই চুপ হয়ে থাকে যাতে তাদের শব্দ শুনে শিকারী তাদের নিকট আসতে না পারে। অথচ অন্য সময় বাবা মায়ের ডাক শুনলে বাচ্চাগুলোও ডেকে উঠে কিন্তু বিপদের ডাক শুনে বাচ্চাগুলো ডেকে উঠে না বরং চুপ হয়ে যায়। এটিই সতর্ককরন ডাক।
এই সতর্ক ডাক দোয়েল পাখির একটি সহজাত আচরন। যা দোয়েল পাখির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলছে। বাচ্চাকাল থেকেই দোয়েল পাখি এই ডাকের সাথে পরিচিত হয়ে উঠে।
নতুন দিনকে স্বাগতম জানানোর ডাক
দোয়েল পাখি সাধারণত সূর্যোদয়ের আগেই ডাকাডাকি শুরু করে। দিনের শুরুতে এই ডাকাডাকির উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন দিনকে স্বাগতম জানানো। রাত্রীর অন্ধকার কেটে যখন দিনের আলো ফোটা শুরু হয় তখনি দোয়েল পাখির মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। তারা মনের খুশিতে জোরে জোরে শিস দিয়ে ডাকতে শুরু করে। নতুন দিনে সবাইকে তাদের উপস্থিতি আর মনের আনন্দর কথা জানানোর জন্যই তারা এমন করে থাকে। শিস দেওয়ার মতো এই ডাকগুলো শুনতে খুবই মিষ্টি এবং মনোমুগ্ধকর।গ্রামঅঞ্চলে অনেকেই মনে করেন এই আহ্বান মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য। সকালে পাখি ডাকাটা পাখিদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। পেঁচা ছাড়া প্রায় সব পাখিই দিনের বেলা খাবার খায় কিংবা উড়ে বেড়ায়। পাখির যাবতীয় কার্যক্রম দিনের আলোতেই হয়ে থাকে। তাই রাতে অন্ধকার পাখিদের জন্য ভয়ের। কারন বেশীর ভাগ শিকারীই রাতের অন্ধকারে তাদের শিকার করার জন্য বের হয়। তাই রাত শেষে যখন দিনের আলো শুরু হয় এবং রাতের অন্ধকার দূর হয়ে আলো জ্বলে উঠে তখন পাখিরা খুশিতে নাচতে থাকে এবং মনের সুখে ডাকাডাকি করে।
উপস্থিতি জানানোর ডাক
প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব অঞ্চল রয়েছে। তারা অন্য কাউকে তাদের নিজ এলাকায় আসতে দেয় না বিশেষ করে প্রজনন মৌসুমে অন্যকোন পুরুষ পাখিকে তাদের নিজেদের এলাকায় আসতে দেয় না। নিজের এলাকার দখন বুজাতে দোয়েল পাখি এক ধরনের ডাক দেয়। যা শুনে অন্য পাখিরা বুজতে পারে উক্ত এলাকা দখল হয়ে গেছে সেইখানে যাওয়া যাবে না। এছাড়াও দলের অন্য সদস্যদের নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে দোয়েল পাখি এমন ধরনের ডাক দিয়ে থাকে।
আনন্দের ডাক
দোয়েল পাখি দিনের বেশীর সময়ই ডাকাডাকি করে থাকে। আর এই ডাকের বেশীরভাগ ধরনই হচ্ছে তাদের আনন্দের ডাক। খাবারের খোজে বের হয়ে এরা ছোট ছোট গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে ছুটাছুটি করে এবং জোরে জোরে শিস দিতে থাকে। এই সময় এরা এদের লেজ উপরে তুলে নাচতে থাকে এবং ক্রমাগত ডাকতে থাকে। এই ডাক গুলো আনন্দের ডাক। খুশির ডাক।
প্রজননকালীন ডাক
দোয়েল পাখির প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। এই সময়ে পুরুষ দোয়েল পাখির গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। প্রজনন মৌসুমে, পুরুষ ডোয়েল ক্রমাগত মিষ্টি শিস দিয়ে মেয়ে দোয়েল পাখির আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। যতক্ষণ না সে সফল না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ক্রমাগত মেয়ে পাখিটিকে প্রজননে অংশ গ্রহণ করার জন্য ডাকতে থাকে। এই ধরনের ডাক হচ্ছে প্রজননকালীন ডাক। ক্রমাগত ডাকার ফলে একসময় স্ত্রী পাখি সেই ডাকে সাড়া দেয় এবং দুইজন কিছুক্ষন একসাথে নাচানাচি করে মিলনে অংশ নেয়।
আগ্রাসী বা ভয়ংকর ডাক
প্রতিটি প্রানীল আত্মরক্ষার কৌশল ভিন্ন ভিন্ন। তবে আত্মরক্ষার চেষ্টাই সব প্রানীদেরই আছে। স্ত্রী দোয়েল পাখি যখন বাসায় ডিম পাড়ে বা ডিমে তা দেয তখন পুরুষ দোয়েল পাখি বাসার আসে পাশেই থাকে। কোন শিকারী যেমন শিয়াল, বিড়াল, বাজপাখি ইত্যাদি বাসার কাছাকাছি আসলে পুরুষ দোয়েল পাখিটি উচ্চস্বরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে এবং আক্রমণাত্মক ভাবে শিকারীর দিকে তেড়ে যায়। মূলত শিকারীকে দূরে রাখতে কিংবা ভয় দেখাতে পুরুষ দোয়েল এমন আক্রমণাত্মক ডাকাডাকি করে থাকে।
আবার দোয়েল পাখির বাচ্চার বয়স যখন ২০-২৫ দিন হয় তখন পুরষ দোয়েল পাখি এমন ভয়ংকর ডাকাডাকি করে বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয়। মূলত বাচ্চারা স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করার জন্য এবং পিতার দায়িত্ব হতে অব্যহতি পাওয়ার জন্য পুরুষ দোয়েল এমন আগ্রসী আচরন করে থাকে।
মন্তব্য
যোগাযোগ প্রতিটি প্রানীর জন্য অপরিহার্য। পাখিরা যোগাযোগ করার জন্যই ডাকাডাকি করে থাকে। দোয়েল পাখিও তাদের নিজেদের মাঝে যোগাযোগের জন্য ডাকাডাকি করে থাকে। তাদের মিষ্টি ডাকা আমাদের কাছে শ্রুতিমধুর মনে হয় বলেই আমরা তাদের ডাককে গান হিসেবে গননা করি। যেহেতু দোয়েল পাখি সারাক্ষনই কম বেশী ডাকাডাকির মাঝে থাকে তাই তাদের গায়ক পাখি বলা হয়। আর গায়ক পাখি হিসেবে দোয়েল পাখির সুনাম এখনো অক্ষত রয়েছে।
দোয়েল একটি সুন্দর ও মিষ্টি পাখি। ক্রমাগত নগরায়নের কারণে তাদের বাসস্থান দিন দিন কমে যাচ্ছে আর দোয়েল পাখিও আমাদের মাঝ হতে কমে যাচ্ছে। এতে করে আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। উপর তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত আমাদের নিজের অবস্থান থেকে এই পাখির জন্য কিছু করার চেষ্টা করা। যাতে এই সুন্দর পাখিটি বিলুপ্ত না হয়।