লাল শিয়ালের আবাস, খাদ্যাভাস, আচরন, প্রজনন ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
শিয়ালের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আগে গ্রাম বাংলার সর্বত্রই শিয়াল দেখা যেতো কিন্তু শহরায়ন ও নগরায়নের চাপে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে শিয়ালের আবাসভূমি। তাই শিয়ালও আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম অঞ্চলে আগে রাতে শিয়াল হুক্কা হুয়া ডাক নিয়মিত শোনা যেতো। এখন তা কদাচিৎই শোনা যায়।
শেয়াল (Source Wikimedia Commons) |
শিয়ালের পরিচিতিঃ
আমরা শিয়াল বলতে যা বুজি তা হচ্ছে লাল শিয়াল। শিয়াল এর ইংরেজী Jackal আর খেক শিয়ালের ইংরেজি Fox. সচারচর আমরা শিয়াল এবং খেক শিয়াল দুইটাকেই এক করে ফেলি যদিও দুইটি ভিন্ন প্রজাতির। লাল শিয়াল খেক শিয়ালের একটি উপ প্রজাতি।
শিয়াল প্রজাতির সবেছেয়ে বড় অংশ হচ্ছে এই লাল শিয়াল। প্রানীজগতে এরা Chordate পর্বের Canidae পরিবারের স্তন্যপায়ী প্রানী। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Vulpes vulpes । স্তন্যপায়ী প্রানীদের মধ্যে মানুষের পরেই এরা পৃথিবীর সবছেয়ে বেশী এলাকাজুড়ে বিচরন করে আছে।
বর্তমান পর্যন্ত লাল শিয়ালের ৪৫টি উপপ্রজাতি চিহ্নিত করা গেছে, যা দুটি ভাগে বিভক্ত; বড় নর্দান ফক্স এবং এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বেসাল সাউথার্ন ফক্স।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম লাল শিয়াল দেখা যায়। তখন থেকে এটি পুরো মহাদেশ জুড়েই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লাল শিয়াল অনেক বুদ্ধমান প্রানী যার কারনে সে অন্য সকল প্রানীর তুলনায় সবার কাছে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।
শিয়ালের ভৌগলিক এলাকাঃ
আমেরিকান রেড ফক্স (সোর্স Wikimedia Commons) |
শেয়ালের আবাসভূমিঃ
শেয়ালের খাবারঃ
শেয়ালের প্রজননকালীন আচরনঃ
নবজাতক শিশু শিয়ালগুলো দেখতে বাদামী বা ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে। বয়স একমাস পার হওয়ার পর আস্তে আস্তে এদের লাল পশম দেখা যায়। বাচ্ছাদের যত্ন পিতা মাতা দুইজনেই করে থাকে এবং পুরো গ্রীষ্মকালে বাবা মা মিলিত ভাবে বাচ্ছাদের যত্ন নেয় এবং বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে শিকার ধরার প্রশিক্ষন দিয়ে থাকে। শরৎকাল আসলে বাচ্ছাদের স্বাধীনভাবে চলার জন্য আলাদা করে দেয়।
মেরু অঞ্চলের শিয়াল ( Source needfix) |
শেয়ালের সামাজিক আচরনঃ
শিয়াল প্রসাবের সাথে এক ধরনের ফেরোমন নিঃসরন করে। যার মাধ্যমে তারা তাদের ভৌগলিক এলাকা চিহ্নিত করে রাখে একই সাথে তা যোগাযোগের কাজও করে।
রাতের আধাঁরে আমরা সবাই শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকের সাথে পরিচিত। এই ডাকটি বেশির ভাগ সময় অন্য শিয়ালদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহার করে থাকে।
শেয়ালের শারীরিক বৈশিষ্ট্যাবলীঃ
প্রাপ্তবয়স্ক লাল শিয়ালের ওজন প্রায় ৫-১০ কেজি হয় তবে ১৪ কেজি ওজনের শিয়ালও দেখা গেছে। আকারে, স্ত্রী শিয়াল পুরুষ শিয়ালের চেয়ে কিছুটা বড় হয়ে থাকে।
নাম লাল শেয়াল হলেও মাঝে মাঝে সোনালী, লালচে বাদামী, রূপালী এমনকি কালো রঙ্গেরও দেখা যায়। লাল শিয়ালের পিছনে, পাশে এবং মাথায় কমলা-লাল পশম রয়েছে। এর ঘাড়ের নীচে এবং বুকে সাদা পশম রয়েছে। লাল শিয়ালের লম্বা পশমের ভিতরে ছোট ছোট নরম পশম থাকে যা সাধারণত লালচে বাদামি। এর লেজটির শেষ প্রান্ত প্রায়শই সাদা কিংবা কালো হয়ে থাকে এবং এদের পায়ের নিছের অংশ কালো পশম থাকে এবং কানের পিছনের অংশ কালো বর্ণের হয়।
শিকার ধরাঃ
এরা চলমান কোন প্রানীকে শিকার করতে গেলে আগে দূর থেকে দাঁড়িয়ে সেই প্রানীটাকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করবে। তারপর দ্রুততার সাথে লম্বা লাফ দিয়ে শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং শিকারকে পায়ের সাহায্যে মাটিতে ভূপাতিত করে। শিয়াল খাবার সঞ্চয় করে রাখে গর্তে কিংবা কোন গোপন স্থানে। পরে ক্ষুদা পেলে তা খেতে পুনরায় ফিরে আসে।
শিয়াল নিজেকে সকল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছে অপর দিকে নগরায়ন কিংবা জঙ্গল উজাড়ের ফলে শিয়াল শিকার করা নেকড়ে কিংবা অন্যান্য বড় শিকারী প্রানীদের সংখ্যা কমে গেছে যার ফলে শিয়ালের বংশবিস্তার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে খাবারের জন্য এরা লোকালয়ে চলে আসে কিংবা গৃহপালিত পাখিদের উপর হামলা করে। অনুমান করা হয় দক্ষিন আমেরিকায় লাল শিয়াল প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়ন বুনো হাঁসকে হত্যা করে।
মেরু অঞ্চলের শিয়াল কিংবা যেসব অঞ্চলে তুষারপাত হয় সেইসব অঞ্চলের শিয়ালগুলো খাবার সন্ধানের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয় বিশেষ করে তুষারপাতের সময়। মেরু অঞ্চলের শিয়ালের শিকার ধরার ছোট একটি ভিডিও দেখতে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন।
লাল শিয়ালের শিকারীঃ
শিয়াল যেমন শিকারী প্রানী তেমনি শিয়ালকে শীকার করার জন্যও শিকারী প্রানী আছে। অল্প বয়স্ক লাল শিয়ালগুলি প্রাথমিকভাবে ঈগল দ্বারা আক্রমনিত হতে পারে। পরিপক্ক লাল শিয়ালগুলি ভালুক, নেকড়ে এবং পর্বত সিংহ সহ বৃহত্তর প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে শিয়ালের সবছেয়ে বড় শিকারী মানুষ। মানুষ ফসল কিংবা গৃহপালিত হাঁস মুরগি শিয়ালের হাত হতে রক্ষা করার জন্য শিয়াল শিকার করে। তবে শিয়ালের চাড়মা এবং পশমের জন্যে ব্যাপক বাবে শিকার করা হয়।
শিয়ালের ডাকঃ
শিয়ালের অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ
লাল শিয়ালের উপকারী দিক ও অপকারী দিক দুটাই আছে।
শিয়ালের উপকারী দিকঃ
উপকারী দিক বিবেচনায় আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পাই।
০১. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় শিয়াল গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। এরা বাস্তুতন্ত্রের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেনীর খাদক।
০২. ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ হতে ফসলকে রক্ষা করে।
০৩. গর্তবাসী ইঁদুর, চিকা, খরগোশ কিংবা পাখির ঝাঁকের আক্রমন হতে ফসলের মাঠকে রক্ষা করে। একই সাথে এগুলো দমনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে।
০৪. শিয়ালের চাড়মা এবং পশমের অনেক অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে তাইতো রাশিয়ায় লাল শিয়ালকে গৃহপালিত করার চেষ্টা চলমান আছে এবং একারণে গৃহপালিত লাল শেয়াল দেখা যায়।
০৫. বুদ্ধিমান প্রানী হিসেবে শিয়াল মানব সভ্যতার বহু পৌরণিক এবং মিথলজিতে উপস্থাপিত হয়েছে। শিয়াল মানব সাংস্কৃতির সাথে জড়িত আছে গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতার মাধ্যমে।
শিয়ালের ক্ষতিকর দিকঃ
অপকারী দিক বিবেচনায় আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পাই।
০১. লাল শিয়াল গৃহপালিত হাঁস মুরগি খেয়ে আমাদের অনেক ক্ষতি করে।
০২. পোষা প্রানী কিংবা গবাদি পশুর উপরও মাঝে মাঝে হামলা করে আমাদের ক্ষতি করে।
০৩. শিয়াল অস্ট্রেলিয়ায় স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রানী ও পাখি সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিকারক প্রানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় এর এমন উপস্থিতির কারণে এটি বিশ্বের ' ১০০ খারাপ আক্রমণাত্মক প্রজাতি' হিসেবে তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
লাল শিয়াল সর্ম্পকে কিছু মজার তথ্যঃ
০১. যদিও লাল শিয়ালটি মূলত উনিশ শতকে ইউরোপ থেকে প্রবর্তিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় তবে সাম্প্রতিক ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এই শেয়ালগুলি উত্তর আমেরিকার দেশীয়।
০২. শিয়াল নেকড়ে, কোয়েটস এবং গৃহপালিত কুকুরের সাথে সম্পর্কিত। এরা একে অপরের চাচাতো ভাই তবে শিয়াল সবছেয়ে চালাক এবং র্ধূত।
০৩.লাল শিয়াল খুব দ্রুত গতিতে ছুটতে পারে। এরা প্রতি ঘন্টা ৩০ মাইল গতিতে পৌঁছতে পারে।
০৪.লাল শেয়ালগুলি ছয় ফুটেরও বেশি উঁচুতে লাফাতে পারে।
০৫.লাল শিয়াল শীতকালে শরীর গরম রাখার জন্য কম্বল হিসাবে তার লম্বা পশমওয়ালা লেজ ব্যবহার করে।